অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ কর




প্রশ্নঃ “নদী তীরবর্তী অন্ত্যজ মানবপ্রবাহের ভাঙা-গড়ার ছন্দে আন্দোলিত জীবনের বিশাল ক্যানভাস অবলম্বিত হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে।”- উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।

অথবা, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে লেখক তিতাস নদী-তীরবর্তী মানুষের জীবনচিত্রের যে রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তা বর্ণনা কর।


উত্তরঃ নদী তীরবর্তী অন্ত্যজ মানবপ্রবাহের ভাঙা-গড়ার ছন্দে আন্দোলিত জীবনের বিশাল ক্যানভাস অবলম্বিত হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১] রচিত “তিতাস একটি নদীর নাম' [১৯৫৬] উপন্যাসে। বিষয়ভাবনা ও শিল্পরূপ বিচারে এ গ্রন্থ আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রায় শর্তই পূরণ করেছে। ভৌগােলিক সীমাসংহতি, মানবমনের ওপর ভূ-প্রকৃতির সর্বাত্মক প্রভাব, মানুষে-প্রকৃতিতে অন্তরঙ্গ যােগ, জীবন-স্বাদের অনন্য একমুখীনতা ও সার্বভৌমতা যেমন এ উপন্যাসে বিদ্যমান, তেমনি চরিত্রায়ণ, দৃষ্টিকোণ ও ভাষাবিন্যাসে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক কাঠামাের জীবন প্রাণময় রূপ লাভ করেছে। মহাকাব্যিক ফ্রেমের মধ্যে যে জীবনকে রূপদান করেছেন ঔপন্যাসিক তা নদীর মতােই কখনাে বাকপরিবর্তনকারী, ভাঙন ও নির্মাণশীল।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে মূলত অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন-কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। তিতাস নদী-তীরে বসবাসকারী মালােদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা-চিত্রের সমন্বয়ে তাদের জীবনের সামগ্রিক রূপটি যেন এক বিশাল ক্যানভাসে এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। ফলে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আচার-আচরণ, রুচি-সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুভূতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ-পরােক্ষভাবে স্থান পেয়েছে এ উপন্যাসে। মালােদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন তিতাস নদী।

তিতাসের সঙ্গে তাদের জীবন সম্পর্কের যে খণ্ড খণ্ড চিত্র তৈরি হয় নিত্য, তারই আলেখ্য এ রচনা। ফলে এ উপন্যাসের কাহিনিও যেমন তিতাসকে নিয়ে আবর্তিত, চরিত্রগুলাের বিকাশও ঘটেছে তেমনই তিতাসকে অবলম্বন করে। এ উপন্যাসে মালােদের সংস্কৃতির জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন। বাসন্তীরা সেই সংস্কৃতি আজীবন লালন করে। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে মাােরা চিরবঞ্চিত হলেও বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয়। তিতাসে অদ্বৈত সামাজিক সত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ উপন্যাসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরবর্তী মালাে জেলেদের কর্ম-ধর্ম-স্বপু-সংস্কতিতিক জীবন নিয়ে রচিত। শুধু এ অঞ্চলের মানুষের কাহিনি এবং তার সীমার মধ্যেই সেটি আবদ্ধ থেকেছে। এমনকি কাহিনিটি নিকটস্থ কুমিল্লাতেও বিস্তৃত হতে পারেনি। সে কারণে, উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলভিত্তিক। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম' একটি ভৌগােলিক অঞ্চল নির্ভর হয়ে সূচিত ও বিকশিত হয়েছে।

‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে ঔপন্যাসিক কেন্দ্রীয়ভাবে এমন কোনাে একটি চরিত্রকে বিকশিত করেননি। যাকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারতাে অন্যান্য চরিত্র। রচনাটিতে স্থান পেয়েছে তিতাস তীরের মালােদের জীবনের একের পর এক ঘটনা। এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে তিতাস নদীর ‘শাহী মেজাজ’ উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিতাস নদীর স্বাভাবিক ধারার সঙ্গে ঔপন্যাসিক তুলনা করেছেন পাশের নদী বিজয়ের। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের রং রেখা স্বভাব দার্শনিকতামণ্ডিত করে পরিবেশন করেছেন। ‘প্রবাস খণ্ডের’ শুরুতে তিনি মালােপাড়ার অবস্থা অবস্থান, ঘর গেরস্থালির স্বরূপ অঙ্কন করেছেন এভাবে-
“তিতাস নদীর তীরে মালােদের বাস। ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানাে জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তকলি সুতা কাটার, জাল বােনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালােদের সংসার। নদীটা যেখানে ধনুকের মত বাঁকিয়াছে, সেইখান হইতে গ্রামটার শুরু। মস্ত বড় গ্রামটা তার দিনের কলরব রাতের নিশুতিতেও ঢাকা পড়ে না। দক্ষিণপাড়াটাই গ্রামের মালােদের।”

মালােপাড়ার দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, বঞ্চিত, বিড়ম্বিত ও নিগৃহীত ধীবর সম্প্রদায়ের একটি পূজাব্রতকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাংশ উন্মােচন করেছেন লেখক। এ পূজাব্রতের নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত। এ ব্রতের স্থায়িত্বকাল সারা মাঘ মাস। এ মাসে কুমারী কন্যারা প্রার্থিত বরের আকাঙক্ষায় এ পূজা করে। এতপ্রসঙ্গে লেখকের বর্ণনাংশ লক্ষণীয়-
“এ পাড়ার কুমারীরা কোনকালে অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে। খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢােল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু এই বিবাহের জন্য তারা দলে দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে। মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে, প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভাটফুল তার দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিড়ি পূজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াছে, লও লও সুরুজ ঠাকুর লও স্কুটার জল, মাপিয়া পুখিয়া দিব সপ্ত আজল। আজ তাদের শেষ ব্রত। তরুণ কলাগাছের এক হাত পরিমাণ লম্বা করিয়া কাটা ফালি, বাঁশের সরু শলাতে বিধিয় ভিত করা হয়। সেই ভিতের উপর গড়িয়া তােলা হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি ঘর। আজিকার ব্রত শেষে ব্ৰতিনীরা সেই চৌয়ারি মাথায় করিয়া তিতাসের জলে ভাসাইবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢােল কাসি বাজিবে, নারীরা গীত গাহিবে।”
এ খল-বাওয়া উপলক্ষ্যে এখানকার একটি পরিবারের কেননা এক তন্বী-তরুণীকে কেন্দ্র করে চৈত্রের মাঝামাঝি পর্যায়ে ফাগ-রাঙানাে দোলপূর্ণিমার উৎসবে কিশাের অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হয়। বসন্তের উৎসবমুখর এ উদাত্ত দিবসে অজানা আবেগে স্পন্দিত হয় কিশােরের হৃদয়, পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়কালে অনঙ্গ দেবতা যেন তাদের অজান্তেই নিক্ষেপ করে পুস্পশর। অতঃপর-
“কিশােরের গালে আবির দিতে মেয়েটার হাত কাঁপছিল; বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তার ছন্দময় হাতখানার কোমল স্পর্শ কিশােরের মনের এক রহস্যলােকের পদ্মরাজের ঘােমটা ঢাকা দলগুলিকে একটি একটি করিয়া মেলিয়া দিল। সেই অজানা স্পর্শের শিহরণে কাপিয়া উঠিয়া সে তাকাইল মেয়েটির চোখের দিকে। সে চোখে মিনতি। সে মিনতি বুঝি কিশােরকে ডাকিয়া বলিতেছে : বহু জনমের এই আবিরের থালা সাজাইয়া রাখিয়াছি তােমারই জন্য। তুমি লও আমার আবিরের সঙ্গে তুমি আমাকেও লও।”
দোল পূর্ণিমার উৎসবে যে মেয়েটির রূপবিভায় মুগ্ধ ও চমকিত হয় কিশাের, সেই মেয়েটিকেই মােড়ল-গিন্নির সহায়তায় গান্ধর্ব-বিধানে বিবাহ করে কিশাের এবং সেখানকার মালাে সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি নিয়ে সে তার স্বগ্রাম গােকনঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথিমধ্যে মেঘনার অথৈ জলে রাত্রির অন্ধকারে দস্যুদলকর্তৃক অপহৃত হয় কিশােরের স্ত্রী ও সম্পদ দুই-ই। অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক এ ঘটনায় বিধ্বস্ত হয় কিশােরের হৃদয় এবং চিরকালের জন্য উন্মাদ হয়ে যায় সে।

‘নয়াবসত’ অংশেও ঘটনার আকস্মিকতা লক্ষ করা যায়- চার বছর পর কিশােরের স্ত্রী ও তার গর্ভের সন্তান অনন্তর সংবাদ পাওয়ায়। নদীর তীরে গৌরাঙ্গ মাললা ও নিত্যানন্দ মালাে পেয়েছিল মৃতপ্রায় অনন্তর মাকে। ‘রাজার ঝি’ বলে তারা তাকে লালন পালন করেছিল। গােকনঘাট গ্রামে নতুন করে পুত্র অনন্তকে নিয়ে সংসারধর্ম শুরু হয় কিশােরের স্ত্রীর। এ অচেনা পরিবেশে পদার্পণ করে কিশােরের স্ত্রী প্রথমাবধি অনুভব করে গ্রামবাসীদের উষ্ণ আন্তরিকতা। সহযােগিতার হাত মা সম্প্রসারিত করে সবাই। বসতঘর নির্মাণের পর জীবন জীবিকার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় অনন্তর মা। মালােপাড়ার অধিকাংশ নারী লক্ষ্মীর মতাে সেও সুতা বুননের মাধ্যমে জীবিকার্জনের উপায় করে নেয়। কৃচ্ছসাধনার মধ্য দিয়ে পুত্র অনন্তকে নিয়ে সে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নঘাের বাস্তবতায় পথ চলে সে। যে নতুন সমাজ প্রকারে সে। স্বেচ্ছাবন্দিনী, সে সমাজের প্রথা পদ্ধতি কখনাে কখনাে তাকে আতঙ্ক শিহরিত করে; দুরদুর বক্ষে সে অপেক্ষা করে ভয়ংকর কোনাে তথ্যচিত্রের। কারণ একদিন-
“সন্ধ্যার অল্প আগে দুইটি ছেলে বাড়িবাড়ি নিমন্ত্রণ করিতে আসিল। ছেলে দুটি পাড়ার এক প্রান্ত হইতে শুরু করিয়া প্রত্যেক বাড়িতে বলিয়া গেল, ঠাকুর সকল, ঘরে নি আছ, আমার একখানা কথা। ভারতের বাড়িতে আজ দশজনের সভা তােমরার নিমন্ত্রণ। পান তামুক খাইবা, দশজনের দশকথা শুনবা।”

বাধা কথা। অনন্তর মাও বাদ পড়িল না। বিশেষত বৈঠকের সঙ্গে যার মামলা জড়ানাে থাকে, ঘােষক জনগণের আহ্বান তাকে বিশেষভাবে জানাইবে ইহাই নিয়ম। দশজনের সভার কথা ভেবে অনন্তর মা আতঙ্কিত হয়। কারণ, এ সভায় নির্ধারিত হবে তার অদৃষ্টলিপি। সে-ই এ সভার মূল আকর্ষণ। একথা ঠিক যে, ভালাে ও মন্দ মানুষের মিলিত সমবায়ে নির্মিত হয়েছে গােকনঘাটের ধীবরপল্পি । এখানে অসংস্কৃত, বিকৃত ও স্থূলরুচির মানুষের সংখ্যা যেমন কম নয়, ঠিক তেমনি সংবেদনশীল মানুষও প্রচুর। নতুন গ্রামে নতুন মানুষ অনন্ত ও অনন্তর মাকে গ্রহণ বর্জনের প্রসঙ্গেও এ মানুষগুলাে হয়ে উঠতে পারে স্ব-স্বভাবে উজ্জ্বল। মালােপাড়ার প্রাকৃত জীবন পরিবেশ বসবাস বিষয়ে সামাজিক অনুমােদনের প্রাক-লগ্নে অনন্তর মা যে পরিস্থিতির মুখখামুখি হয় তা এ সমাজেরই অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য।

শুধু মালাে সম্প্রদায়েরই নয়, তিতাস-তীরের মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র ও বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে রূপাঙ্কন করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। হিন্দু মুসলিমের সৌহার্দপূর্ণ জীবনযাপন এবং তাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা-চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে এ উপন্যাসে। মালােপাড়ার মাতবর রামপ্রসাদের সঙ্গে শরীয়তুল্লা বাহারুল্লার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় একটি অসাম্প্রদায়িক জনজীবনের। চিত্ৰই ঔপন্যাসিক অঙ্কন করেছেন। একদা ফসল কাটার মৌসুমে মুসলমান পরিবারের গৃহাঙ্গন উৎসব আনন্দে আর জারিগানের উত্তাল সুরে গমগম করতাে। ‘মনে লয় উড়িয়া যাই কারবালার ময়দানে', ‘জয়নালের কান্দনে’, ‘মনে কি আর মানে রে’, ‘বিরিক্ষের পত্র ঝরে', ‘বাছা তুমি রণে যাইওনা’, ‘চৌদিকে কাফিরের দেশ’, ‘জহর মিললেও পানি মিলে না' প্রভৃতি মর্সিয়া গীত গানে এক সময় যে গৃহস্থপাড়া প্রকম্পিত হতাে, সে পাড়া এখন ফসলের মৌসুমেও নীরব নিথর। কারণ-
“কয়েক বৎসর ভাল ফসল হয় না। চাষীরা কেবলই দেনায় জড়াইয়া যাইতেছে। কােন কোম্পানীর টাকা আনিয়া কত চাষী আর শােধ করিতে পারে নাই বলিয়া প্রতি কিস্তিতে কত শাসানি কত ধমক খাইয়ে মরিতেছে। জারি গাহিবে তারা কোন আনন্দে?”
‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে লেখক মালাে সম্প্রদায় ও কৃষক সম্প্রদায়ের জীবনযাপন পদ্ধতির উৎস ও প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন রামপ্রসাদ ও বাহারুল্লার প্রেক্ষণবিন্দু থেকে। তাদের কথােপকথন লক্ষণীয়-
“বাহারুল্লা বলিল, মাললাগুষ্টি সুখে আছে। মরছি আমরা চাষারা। ঘরে ধান থাকলে কি, কমরে একখানা গামছা জুটেনি? পাট বেচবার সময় কিছু টেকা হয়। কিন্তু খাজনা আর মহাজন সামলাইতে সব শেষ। কত চাষায় তখন জমি বেচে। তােমরা তারার দোয়ায় অখন অবধি আমার জমিতে হাত পড়ছে না। পরে কি হইব কওন যায় না।”
‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ‘জন্ম মৃত্যু বিবাহ' অধ্যায়টি মালাে সম্প্রদায়ের বিবিধ উৎসব ও জীবনাচার বিষয়ক। জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ প্রসঙ্গে মালােপাড়ায় জীবনের যে সাড়া জাগে তা ই অভিজ্ঞতার ভাষা দিয়ে পরিবেশন করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। মালােপাড়ায় রামকেশবের পরিবারের যে বেদনাময় উপাখ্যান, তা যেমন সংবেদনাময়। চিত্তকে আবেগায়িত করে, ঠিক তেমনি কালােবরণের পরিবারের সুখী জীবনযাপন ও উৎসব আনন্দ ও জনপদের বিপুল মানুষকে দেয় বৈচিত্র্যের আস্বাদ। বাসন্তীর সঙ্গে গল্প করে অনন্তর মা বুঝতে পারে, কিশাের পাগলই তার স্বামী। তারপর সে তাকে ভালাে করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে। উপন্যাসের তৃতীয় অংশের প্রথম ভাগেও লক্ষ করা যায় তিতাস নদীর সঙ্গে মানুষ ও হাট-বাজারের সংশ্লিষ্টতা-বিষয়ক ঘটনাবলি। বনমালীর মাধ্যমে কাদির মিয়ার প্রায় ডুবে যাওয়া আলু ভর্তি নৌকা রক্ষা পায়। বনমালীর নদীতে বিচরণের সূত্র ধরে কাহিনি গতি পেয়েছে, বনমালীর মাধ্যমেই অনন্ত গিয়েছে নবীনগর। উপন্যাসটিতে নবীনগরবাসীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ‘জালাবিলা', মনসাপূজা’, ‘পদ্মপুরাণ পাঠ'-এর উপস্থাপনা দেখা। যায়। অবশ্য এ ধরনের ধর্মীয় বিষয় নৌকা বাইচের মতাে সর্বজনীনতা অর্জন করেনি। ‘রাঙা নাও’ পর্যায়ে কৃষক কাদির মিয়ার ছেলে ছাদির মিয়া তৈরি করে বাইচের নাও।

ছাদির মিয়াকে কেন্দ্র করে লক্ষ করা যায় মুসলমান সমাজের বিয়েতে যৌতুক প্রসঙ্গ। ঋণ গ্রহণের ফলে কাদির প্রতারণার শিকার হওয়া এবং মামলা-মােকদ্দমা সম্পর্কিত নানা ঘটনা উপন্যাসের কাহিনিতে স্থান পেয়েছে ছছাটো ছােটো হয় মতাে। কাহিনির এ পর্যায়ে উল্লেখ করার মতাে ঘটনাগুলাে বাইরের বাইচের নৌকা তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত। কাঠ সংগ্রহ নানা ধরনের পেশা, কাঠ চেরাইকারী করাতি, কাঠ মিস্ত্রীদের সঙ্গে জড়িত নৌকার নকশাকার প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন পেশার এ শ্রমজীবী মানুষের উল্লেখ আছে কাহিনির এই অংশে। নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে ঘটেছে আকস্মিকভাবে কয়েকটি ঘটনা।

গােকনঘাট গ্রামে এভাবে বিবিধ উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনন্তের মা ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। উন্মাদ কিশােরকে তার স্বামীরূপে নিঃসন্দিগ্ধভাবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলেও অচেতনসত্তায় সে তার প্রতি একটা বেদনাময়, আকর্ষণ অনুভব এবং লােকলজ্জা ও সংস্কারকে উপেক্ষা করে স্নেহময় পরিচর্যার মাধ্যমে কিশােরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তােলার সাধনায় ব্রতী হয়। দোল-উৎসব উপলক্ষ্যে অপ্রকৃতিস্থ কিশােরকে আবিরে রাঙিয়ে তাদের প্রথম প্রেমাভিষেক স্মৃতি উদ্বোধনের মা অনন্তর মা উদ্যোগী হয়। এর ফলে সেদিন কিশােরর স্মৃতি পথে এক অতীত দোল-উৎসবে শুকদেবপুরের দাঙ্গায় তার স্ত্রী, মূৰ্ছা ঘটনা অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে উদয় হয় এবং সে স্মৃতিবিকারজাত প্রতিক্রিয়ায় সে তার স্ত্রীকে গুরুতরভাবে আহত করে। প্রতিবেশীদের হাতেও কিশাের প্রহৃত হয় নির্মমভাবে। এ দুঃখময় পরিস্থিতির পর দিন চারেকের ব্যবধানে নাটকীয়ভাবে উভয়ের জীবনাবসান ঘটে। এ জীবনাবসানের সঙ্গে সমাপ্ত হয় এ উপন্যাসের একটি বিচিত্র বিবাহ কাহিনি।

উপন্যাসের শেষ অংশের প্রথম ভাগ ‘দূরঙা প্রজাপ্রতি’তে ছাদিরের বাড়িতে বনমালী, উদয়তারা ও অনন্ত যে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হলাে তা বৃহত্তর সমাজ পরিসরের ওপর ফেলে না কোন প্রভাব। বাসন্তী ও মােহন বাইরের চটুল যাত্রাগানের সংস্কৃতি থেকে নিজেদের সুস্থ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করতে চেয়েছে জনমত। তারা প্রথমে এভাবে মালােদের মনােযােগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও, পরে তা আর সম্ভব হয়নি। কারণ, ধীরে ধীরে তিতাসের মাছও যায় কমে। ঠিক এমন একটি সময় ঋণদান কোম্পানির বিধিভূষণ পাল মালােদের মাথায় চাপিয়ে দেয় আরাে ঋণের বােঝা। এক দিকে আয়ের উৎস বন্ধ হয়েছে নদী ভরাট হওয়ার ফলে, অন্যদিকে ঋণের বােঝা। ফলে, জীবন বাঁচাতে মালােরা চলে যায় নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র।

‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘রামধনু'। এ অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিঃস্ব বালক অনন্তের অসহায়-উদাস ও কল্পনাপ্রবণ মনােদৃষ্টিকেই কেবল উপস্থাপন করেননি, সে সঙ্গে তিতাস-তীরের জনজীবন মূলঘনিষ্ঠ জীবনচিত্রও আন্তরিকভাবে অঙ্কন করেছেন। কৃষক আর ধীবরের প্রেমময় ও সৌহার্দময় সম্পর্ক উপস্থাপনের সূত্রে লেখক এ অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা চেতনাও পরিবেশন করেছেন-
“এরা জেলে। চাষার জীবনের মতই এদের জীবন। উঁচু বলিয়া মানের ধূলি নিক্ষেপ করা যায় না এদের উপর, বরং সমান বলিয়া গলায় জড়াইয়া ধরিতেই ভালাে লাগে। কাটিলে কাটা যাইবে না, মুছিতে মুছা যাইবে না, এমনি যেন একটা সম্পর্ক আছে জেলেদের সঙ্গে চাষিদের।”
উপযুক্ত উদ্ধৃতিতে যেমন তিতাস তীরবর্তী মানুষের অসাম্প্রদায়িক জীবনচেতনা পরিস্ফুট হয়েছে, ঠিক তেমনি তাদের সংবেদনশীল মননদৃষ্টিও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মায়ের মৃত্যুর পর এরকম উদার সংবেদনশীল জীবনপরিবেশে অনন্ত আশ্রয় খুঁজে পায়। অর্থনৈতিক অনটন সত্ত্বেও বাসন্তী মাতৃস্নেহে আগলে রাখে অনন্তকে। কিন্তু বালক অনন্ত অনন্তপথের অভিযাত্রিক। সংসারের সীমাবদ্ধ আঙিনা ছেড়ে সে ছড়িয়ে পড়তে চায় প্রকৃতির বিশাল সৌন্দর্যলােকে। এ উপন্যাসে মায়ের মৃত্যুর পর অনন্তের বাধা বন্ধনহীন স্বেচ্ছাবিহারী অবস্থাকেই শুধু চিত্রিত করেননি লেখক, সে সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, মায়ের মৃত্যুর পর মাসাধিক পালিত হবিষ্য প্রথা।

অনন্ত মেধাবী ছাত্র। তার প্রতিভায় মালােরা মুগ্ধ। সকলে অনন্তর ব্যাপারে তাই পােষণ করতে থাকে উচ্চাশা। অনন্তকে মালােরাই ভর্তি করিয়ে দেয় গােপালখালি মাইনর স্কুলে। চিঠি লিখতে, তমসুকের খত লিখতে, বেপারীর সঙ্গে মাছের খাতার হিসাব লিখতে মালােদের যেতে হয় হরিদাস সারের কাছে। তাকে অনেক অনুরােধ করে, বড় বড় মাছ দিয়ে, টাকা দিয়েও অনেক সময় কাজ পেতে কষ্ট হয়। মালােদের এই অভাব মেটানাের দায়িত্ব যেন বর্তায় অনন্তর কাঁধে। কিন্তু লাভ হয়নি মালােদের। উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে মহামারীর মতাে মৃত্যু এসে মালােদেরকে নিশ্চিহ্ন ও সর্বস্বান্ত করে দেয়। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে কোনাে রকমে টিকে থাকে বাসন্তী আর কিশােরের বৃদ্ধ পিতা রামকেশব। অনন্ত কুমিল্লার শাহরিক পরিবেশে শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠলেও গােকনঘাটের মালাে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরুদূর। অনন্ত বালারা চলে যায় আসামে। নিস্তব্ধ ও প্রায়লুপ্ত বিশাল মালােপাড়া কালের সাক্ষী হয়ে হতশ্রী রূপ নিয়ে পড়ে থাকে। উপন্যাসের একেবারে অন্তিমে লেখক মালােপাড়ার যে হতদশা অঙ্কন করেছেন তা একান্তভাবে হৃদয়স্পর্শী-
“ধানকাটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধানগাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাঁতার জল। চাহিলে কারাে মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জলে থই থই করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালােপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সে মালােপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালােপাড়া আর নাই। শূন্য ভিটাগুলিতে গাছ গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া সাে সাে শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দের তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।”
‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস তীরের স্থানিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে এতদঞ্চলের মাললা সম্প্রদায়ের আশা আকাঙক্ষা, হতাশা- বেদনা এবং উত্থান পতনের বিস্ময়কর কাহিনি শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ জীবনের অন্তর্কাঠামাের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গী রেখে চৈতন্য প্রবাহও যে পরিবর্তিত হয়ে যায় তা এ উপন্যাসের বিপুল পরিসরে প্রত্যক্ষ করা যায়। তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মানসের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণিমার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক