অথবা, শের শাহের শাসন সংস্কারের বিবরণ দাও।
ভূমিকাঃ উত্থান পতনের যুগ সন্ধিক্ষণে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে আফগান সুর বংশের স্থপতি শের শাহ একজন প্রজাহিতৈষী, সুনিপুণ ও সংস্কারবাদী শাসক হিসেবে ধুমকেতুর ন্যায় ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত হন। মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক কীনী বলেন- No government, not even the British has shown so much wisdom as this pathan.
শের শাহের শাসনব্যবস্থাঃ
১. কল্যাণকর একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাঃ শের শাহের শাসন ব্যবস্থা ছিল একনায়কতান্ত্রিক কিন্তু কল্যাণকর। কারণ তা জনসাধারণের কল্যাণে নিবেদিত ছিল। তার শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিল জনসাধারণের কল্যাণ ও সার্বিক মঙ্গল সাধন এবং রাষ্ট্রের মঙ্গল বিধান করা।
২. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাঃ ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেন, প্রশাসনিক কাঠামাে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শের শাহ কেন্দ্রীয় প্রশাসনে চার জন মন্ত্রী ও চার জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ােগ করে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে চারটি প্রধান দপ্তরে বিভক্ত করেন। যথা-
১. দিওয়ানে ওজারত,
২. দিওয়ানে আরজ,
৩. দিওয়ানে রিসালাত ও
৪. দিওয়ানে ইনশা।
প্রত্যেক দপ্তরে একজন করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
৩. প্রশাসনিক সংস্কারঃ শাসনকার্যের সুবিধার্থে শের শাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে, প্রত্যেকটি সরকারকে কয়েকটি পরগনায় এবং প্রত্যেকটি পরগনাকে কয়েকটি গ্রামে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক পরগনায় একজন করে শিকদার, আমিন, মুনসিফ, কোষাধ্যক্ষ এবং দু’জন কারকুন তথা দলীল লেখক নিযুক্ত করেন।
৪. কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থাঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “শাসনকার্য নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা এবং প্রশাসনকে স্থানীয় শাসকবর্গের প্রভাব মুক্ত রাখার উদ্দেশে তিনি কর্মচারীদের প্রতি তিন বছর অন্তর বদলির ব্যবস্থা করেন।”
৫. ভূমি জরিপ ও রাজস্ব সংস্কারঃ রাজস্ব নির্ধারণের উদ্দেশে শের শাহ সর্বপ্রথম ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন এবং ভূমির উৎপাদিকা শক্তির ওপর ভিত্তি করে উৎপন্ন শস্যের ১.৭৫ অংশ রাজস্ব আদায় করতেন। রাজস্ব আদায়ের জন্য মুকাদ্দাম, চৌধুরী, পাটোয়ারী প্রভৃতি কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। তবে প্রতিকূল অবস্থায় তিনি রাজস্ব মওকুফ ও ঋণদান ব্যবস্থা চালু করেন।
৬. কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রথা প্রবর্তনঃ শের শাহ সর্বপ্রথম কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রথার প্রচলনের মাধ্যমে জনসাধারণের সাথে সরকারের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করেন। কারণ কৃষকগণ তাদের অধিকার, দাবি ও দায়িত্ব বর্ণনা করে সরকার বরাবরে কবুলিয়ত সম্পাদন করে দিত এবং সরকারের পক্ষ থেকে জমির ওপর তাদের স্বত্বাধিকার স্বীকার করে পাট্টা দেয়া হতাে।
৭. শুল্ক সংস্কারঃ ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতির জন্য শের শাহ আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক তুলে দেন। ফলে জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস পায়।
৮. মুদ্রাব্যবস্থার সংস্কারঃ ক্ষমতারােহণ করে শের শাহ মুদ্রাব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন। তিনি প্রচলিত জাল ও বিভিন্ন মানের মুদ্রার বিলােপ সাধন করার লক্ষ্যে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেন, যা পরবর্তীতে তংকা ও রুপাইয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।
৯ সামরিক সংস্কারঃ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে শের শাহ সামরিক বিভাগের কিছু জরুরি সংস্কার সাধন করেন। যেমন-
ক. সৈন্যদের ভর্তির বিষয় তিনি নিজে তদারক করতেন এবং যােগ্যতানুসারে তাদের বেতন দিতেন।
খ. সৈন্যদের মধ্যে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা প্রবর্তন করেন।
গ. সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন।
১০. বিচার ব্যবস্থাঃ শের শাহ ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করতেন। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি। পরগনার বিচারের জন্য আমীন আর ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলা পরিচালনার জন্য কাযী এবং মীরে আদল নিযুক্ত ছিলেন।
১১. পুলিশ বাহিনী সংস্কারঃ শের শাহ দুর্নীতি দমন ও অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশী ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। প্রত্যেক সরকারে অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন একজন মুকাদ্দাম। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে গ্রাম্য মােড়লদের ওপর গ্রামের শান্তি রক্ষার ভার অর্পণ করা হয়।
১২. মুহতাসিবঃ সমাজের অধর্মীয় ও অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ এবং জনগণের নৈতিক জীবনের ওপর দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি মুহতাসিব নিয়ােগদানের ব্যবস্থা করেন।
১৩. গুপ্তচর প্রথা প্রবর্তনঃ সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি গুপ্তচর প্রথা প্রবর্তন করেন। ফলে তার সময়ে চুরি ডাকাতি হ্রাস পায় এবং সর্বত্র শান্তি বিরাজ করে।
১৪. ঘােড়ার ডাকের প্রচলনঃ শের শাহ-ই প্রথম ঘােড়ার ডাকের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। অনেক কর্মচারী ব্যক্তিগত কাজে ঘােড়া ব্যবহার করতেন বলে তাদের ঘােড়া নিয়ে নেওয়া হতাে।
১৫. যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতিঃ যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি বহু সুন্দর ও প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেন। এগুলাের মধ্যে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রােড সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য। পথিকদের সুবিধার জন্য তিনি রাস্তার উভয় পাশে ছায়াপ্রদ বৃক্ষ রােপণ এবং সরাইখানা নির্মাণ করেন।
১৬. ডাক বিভাগ সংস্কারঃ তিনি ডাক ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেন। ঐতিহাসিক ভি. ডি. মহাজন বলেন, “শের শাহ সরাইখানাগুলােতে ‘ডাক চৌকি’ নামে ঘােড়ার ডাকের প্রচলন করেন।”
১৭. শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নঃ শের শাহ শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। হিন্দুরা সংস্কৃত ভাষায় এবং মুসলমানগণ মসজিদ সংলগ্ন মক্তব ও মাদরাসায় আরবি ফারসি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করত।
১৮. স্থাপত্যশিল্পঃ রােটাসগড় দুর্গ, সাসারামে নিজের সমাধি সৌধ এবং দিল্লী পুরান কেল্লায় মসজিদ নির্মাণ শের শাহের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি।
১৯. সরাইখানা নির্মাণঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “শের শাহ রাজ্যে অনেকগুলাে সরাইখানা নির্মাণ করেন। সেখানে রাজ্যের গরিব দুঃখী লােকেরা বিনা খরচে দু’বেলা আহার পেত। এজন্য শের শাহ বছরে প্রায় ৮০০০ স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করতেন।”
১০. দুস্থ মানবতার কল্যাণঃ দুস্থ মানবতার কল্যাণে তিনি বহু অর্থ ব্যয়ে তাদের আহারের জন্য বিভিন্ন সরাইখানা নির্মাণ করেন।
উপসংহারঃ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হলাে শের শাহ। তার শাসন কাঠামাের অনুকরণেই গড়ে ওঠে আকবরের আমলে এক বৃহৎ মুঘল সামাজ্যের কাঠামাে। তাই ঐতিহাসিক হেগ বলেন, “শাসক হিসেবে শের শাহ ছিলেন দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।”
0 মন্তব্যসমূহ