সম্রাট আকবরের রাজপুতনীতি আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সম্রাট আকবরের রাজপুতনীতি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে রাজপুতনীতির প্রবর্তক সমাট আকবর ছিলেন এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। সামরিক শৌর্যবীর্য ও প্রশাসনিক প্রতিভার দিক দিয়ে তদানীন্তন ভারতে রাজপুতরাই শ্রেষ্ঠ ছিল। তাই সম্রাট আকবর বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে রাজপুতদের সহযােগিতা লাভে সচেষ্ট হন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, "Akbars treatment was the result of a deliberate policy and was based on the principles of enlightened self interest."

রাজপুতনীতির পরিচয়ঃ ঐতিহাসিক ভি. ডি. মহাজন বলেন, “রাজপুতদের সাহায্য সহযােগিতা লাভ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও গঠনমূলক কার্যে তাদের নিয়ােজিত রাখার জন্য সমাট আকবর তাদের সম্পর্কে যে উদারনীতি গ্রহণ করেন তাই ইতিহাসে তার রাজপুতনীতি নামে পরিচিত।”

আকবরের রাজপুতনীতি পর্যালােচনাঃ
রাজপুতনীতির কারণঃ
১. পিতৃস্মৃতিঃ আকবরের পিতা হুমায়ুন আফগান নেতা শেরশাহের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিন্ধুর হিন্দু রাজা রানা প্রসাদের আশ্রয়ে থাকাকালীন তার জন্ম হয়। ফলে জন্ম থেকেই তিনি হিন্দু সংস্রবে বেড়ে ওঠেন এবং তার মধ্যে হিন্দুপ্রীতি জাগ্রত থাকে।

২. পারিবারিক ও বাল্য প্রভাবঃ সম্রাট আকবরের মাতা হামিদা বানু এবং তার বাল্য শিক্ষক আবদুল লতিফ ছিলেন উদারপন্থী ও পরধর্ম সহিষ্ণু। তাদের প্রভাবেও তিনি উদারপন্থী হয়ে ওঠেন।

৩. হিন্দু রাজপুত রমণীদের প্রভাবঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “পারিবারিক জীবনে হিন্দু রাজপুত রমণীদের সাথে বিবাহের ফলে তাদের প্রভাবেও আকবর হিন্দুদের প্রতি উদার ও হিন্দু ধর্ম সহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।”

৪. রাজনৈতিক প্রয়ােজনঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলার প্রয়ােজনেও তিনি হিন্দুদের বিশেষত রাজপুতদের প্রতি উদারনীতি প্রদর্শন করেন।

৫. মিলনাত্মক নীতি গ্রহণঃ সম্রাট আকবর বুঝতে পারেন, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে সহাবস্থানের প্রেক্ষিতে মিলনাত্মক নীতি গ্রহণ করা একান্ত প্রয়ােজন। তাই তিনি রাজপুতদের সম্পর্কে কতিপয় উদারনীতি গ্রহণ করেন।

৬. স্বীয় নিরাপত্তার জন্য বিদ্রোহ দমনঃ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই আকবর শাহ মানসুর, মির্জা মুহাম্মদ হাকীম, বৈরাম খান, পুত্র সেলিমের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। ফলে স্বীয় নিরাপত্তা ও বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি রাজপুতদের সমর্থন সহযােগিতা গ্রহণ করেন।

৭. বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অভিলাষঃ সম্রাট আকবর সিংহাসন লাভের পর বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে তার প্রয়ােজন দুর্ধর্ষ রাজপুতদের সহযােগিতা; তাই ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোর জয়ের পর তিনি রাজপুতদের সমর্থন লাভের জন্য তাদের প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করেন।

৮. সম্প্রীতি স্থাপনঃ ভারতের বিশাল সাম্রাজ্যের সকল শ্রেণির মানুষের ভালােবাসা ও সম্প্রীতি অর্জনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ সম্রাট আকবর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দ রাজপুতদের মনােবাঞ্ছা পূরণ এবং তাদের সহানুভূতি লাভের নিমিত্ত রাজপুতনীতি গ্রহণ করেন।

আকবরের রাজপুতনীতিসমূহঃ
১. বৈবাহিক বন্ধনঃ সম্রাট আকবর ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে বিহারীমলের কন্যা যােধবাঈকে বিবাহ করেন এবং ভগবান দাসের কন্যার সাথে পুত্র সেলিমের বিবাহ দিয়ে হিন্দুদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলেন। এভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আকবর রাজপুতদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযােগিতা ও সম্প্রীতি লাভ করেছিলেন।

২. বন্ধুত্বপূর্ণ মিত্ৰতা নীতিঃ আকবরের রাজপুতনীতির মধ্যে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ মিত্রতা নীতি। তিনি উদার ও সহনশীল মিত্ৰতাপূর্ণ ব্যবহার দিয়ে শত্রুর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। তার সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে চিরশত্রু চিরমিত্রে পরিণত হয়েছিল।

৩. উচ্চ পদে রাজপুতদের নিয়ােগঃ আকবর রাজপুতদের যােগ্যতানুসারে বিভিন্ন সামরিক বেসামরিক উভয় বিভাগে উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন। টোডরমল, রাজা বিহারীমল, মানসিংহ, ভগবাদন দাস প্রমুখ সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন। আকবরের একুশ সদস্যবিশিষ্ট সভা পণ্ডিতের নয় জনই ছিলেন হিন্দু।

৪. হিন্দু কবি ও পণ্ডিতদের উচ্চ মর্যাদা প্রদানঃ আকবর হিন্দু কবি, পণ্ডিত, গায়ক, চিত্রকরদেরও স্বীয় দরবারে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেন। সুরদাস ও তুলসী দাসের মতাে কবি, তানসেনের মতাে গায়ক আকবরের পৃষ্ঠপােষকতায় খ্যাতি লাভ করেন।

৫. তীর্থযাত্রীদের কর রহিতকরণঃ হিন্দু রাজপুতদের সাহায্য সহযােগিতা লাভ এবং তাদের মনে আস্থা সৃষ্টির জন্য আকবর ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কর রহিত করেন।

৬. বর্ণবৈষম্য নীতির বিলােপ সাধনঃ সম্রাট আকবর হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্য বিবাহ নিরুৎসাহিত ও বিধবা বিবাহ উৎসাহিত করেন এবং সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। তিনি বর্ণবৈষম্য প্রথাও বিলুপ্ত করেন।

৭. বিভিন্ন কর রহিতকরণ ও জনপ্রিয়তা অর্জনঃ হিন্দুদের মন জয় করার জন্য তিনি ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে জিযিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কর মওকুফ করেন। ফলে সাম্রাজ্যের আয় কমে আসলেও রাজপুতদের সাথে তার সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়।

৮. পশু জবাই নিষিদ্ধকরণঃ রাজপুত জাতির অনুভূতিতে আঘাত না দেয়ার উদ্দেশ্যে আকবর সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলােতে পশু জবাই নিষিদ্ধ করেন, নিজে মাংস ভক্ষণ পরিত্যাগ করেন। গাে-হত্যা বন্ধের জন্যও তিনি প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

৯. হিন্দুদের অনুষ্ঠানে যােগদানঃ আকবর নিজে হিন্দু ও রাজপুত জাতির বহু সামাজিক প্রথা এবং জীবন যাপন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের পূজামণ্ডপ, মেলা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে যােগদান করতেন।

১০. হিন্দু সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতাঃ সম্রাট আকবর হিন্দু সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। কারণ তিনি হিন্দু স্ত্রীদের প্রভাবে হিন্দু সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক সেজে হিন্দুদের নানাবিধ অনুষ্ঠানেও যােগ দিতেন। হিন্দু মন্দির নির্মাণ ও সংস্কারে তিনি অনেক অর্থ দান করেন। তার নির্দেশে এবং হিন্দুদের খুশি করার মানসে মহাভারত, রামায়ণ, অথর্ব বেদ, ভগবত গীতা, লীলাবতী ও রাজতরঙ্গিনী ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়।

১১. ধর্মীয় স্বাধীনতাঃ সম্রাট আকবর রাজপুত হিন্দুদের প্রকাশ্যে এবং স্বাধীনভাবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের সুবিধা প্রদান করেন।

১২. শিক্ষার প্রসারঃ আকবর নিজে নিরক্ষর হলেও হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি ফতেহপুরে একটি মহাবিদ্যালয় স্থাপন করেন। নারী শিক্ষার প্রতিও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তার সময়ে বহু হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়।

১৩. প্রতিরােধ নীতি গ্রহণঃ আকবর রাজপুতদের সাথে মিলনাত্মক নীতি গ্রহণ করলেও যেসব রাজশক্তি তার অবাধ্য ছিল, তাদের তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন।

১৪. দ্বীন-ই ইলাহী প্রবর্তনঃ আকবর দলমত নির্বিশেষে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ এবং হিন্দু ও মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ মিটিয়ে অভিন্ন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে দ্বীন-ই ইলাহী নামক এক নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করেন। এতে তিনি রাজপুতদের মধ্যে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

১৫. পরাজিত রাজপুতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনঃ আকবর চিতাের জয় করার সময় রাজপুত সেনাপতি জয়মল ও পট বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করে পরাজিত এবং নিহত হয়। আকবর তাদের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য আগ্রা দুর্গের সম্মুখে স্মৃতিস্বরূপ জয়মল ও পটের মূর্তি স্থাপন করেন। ফলে রাজপুতগণ আকবরের প্রতি সন্তুষ্ট হন।

রাজপুতনীতির ফলাফলঃ
১. রাজপুতদের মিত্ৰতাপূর্ণ অবদানঃ আকবরের রাজপুতনীতির ফলে শক্তিশালী রাজপুতরা তার সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকবরের শাসনামলে এ দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রগতিতে রাজপুতদের অবদান অনস্বীকার্য।

২. বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনঃ রাজপুত জাতির সহযােগিতার ফলে আকবর বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তার সাম্রাজ্য ছিল সুশৃঙ্খল ও বিদ্রোহমুক্ত।

৩. নবযুগের সূচনাঃ আকবরের রাজপুতনীতির ফলে ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যের পরিবর্তে হিন্দু মুসলিম এক মিলন মােহনায় একীভূত হওয়ায় মুঘল সাম্রাজ্যে নতুন যুগের সূচনা হয়। তাই ঐতিহাসিকগণ বলেন, আকবরের সাম্রাজ্য ছিল রাজপুতদের বীরত্ব ও কর্মদক্ষতার মিলিত ফল।

৪. রাজপুতনীতিতে বিপর্যয়ঃ একথা সত্য, আকবরের রাজপুতনীতি প্রাথমিক পর্যায়ে সুফল বয়ে আনলেও পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

উপসংহারঃ আকবরের রাজপুতনীতি ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। মূলত দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার জন্য তিনি রাজপুতদের অকুণ্ঠ সহযােগিতা ও আনুগত্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, Much of the improvement in administration was due to Akbars employment of Hindus was at that time were better men of business.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক