উপজাতি জনগােষ্ঠির রাজনৈতিক আচরণের বিবরণ দাও


প্রশ্নঃ উপজাতি জনগােষ্ঠির রাজনৈতিক আচরণের বিবরণ দাও।
অথবা, উপজাতি জনগােষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণের বর্ণনা দাও।

ভূমিকাঃ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মত বাংলাদেশেও উপজাতি বাস করে। এদের অধিকাংশই পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) এলাকায় বাস করে। এই উপজাতি সমাজ আজও নিগৃহীত। তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা তাদের রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনে, যা উপজাতি সমাজের রাজনৈতিক উন্নয়নসাধন করে। উপজাতিদের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্ম হয় তখনই, যখন ব্রিটিশ সরকার সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন পার্বত্য জনগণকে উপনিবেশের জালে আবদ্ধ করে।

বাংলাদেশের উপজাতি জনগােষ্ঠির রাজনৈতিক আচরণসমূহঃ উপজাতীয় সমাজব্যবস্থা কোনাে প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নয়, এদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজস্ব পরিবেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই প্রবর্তিত হয়েছে। উপজাতিদের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্ম হয় তখনই, যখন ব্রিটিশ সরকার সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন পার্বত্য জনগণকে উপনিবেশের জালে আবদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আচরণসমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) চন্দ্রযােনা কাগজ কল এবং বৈষম্যঃ পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় গৃহিত শিল্পায়ন প্রক্রিয়া উপজাতীয়দের উৎসাহিত করার পরিবর্তে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই জন্ম দিয়েছিল। ১৯৫২ সালে চন্দ্রঘােনায় বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কাগজের কারখানাকে উপজাতিরা মিশ্র দৃষ্টিতে দেখেছিল। প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি হওয়ার কারণে অভিজ্ঞ শ্রমিক ও কর্মচারি নিয়ােগের ফলে অশিক্ষিত উপজাতিদের তুলনায় অগ্রাধিকার পেল সমতলের লােকেরা। তারা পেল গভীর অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করার দায়িত্ব।

(২) কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প এবংরাজনৈতিক সচেতনতাঃ পাকিস্তান আমলে উপজাতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষোভের জন্ম দেয় কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প। ১৯৫২-৫৩ সালে পাকিস্তান সরকার বহুজাতিক কোম্পানির সহায়তায় কর্ণফুলী নদীর মােহনা থেকে ৩৫ মাইল উজানে কাপ্তাই নামক স্থানে জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ১৯৬০ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীতে, ৩০০ বর্গমাইলের একটি বিশাল জলাধারের সৃষ্টি হয়। এই জলাধারের কারণে জলমগ্ন হয়ে প্রায় ৫৪০০০ একর উর্বর উপজাতীয় কৃষি জমি এবং বসত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১০,০০০ সমতল ভূমি চাষি পরিবার এবং ৮,০০০ জুম চাষি পরিবার; সর্বমােট প্রায় ১,০০,০০০ লােক এ কারণে ডুবে যায়। ডুবে যায় পুরনাে রাঙামাটি জেলা শহর। পাকিস্তান সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করলেও দেয়া হয় মাত্র ২.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পূনর্বাসন প্রক্রিয়াও ছিল অগােছালাে। এভাবে উপজাতীয়দের মনে যে ক্ষোভ সঞ্চিত হতে থাকে, তা দূর করার জন্য পাকিস্তান সরকার কোনাে প্রকার গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে সমস্যাটি দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।

(৩) সংবিধানে উপজাতীয় এলাকা সংযোজন এবং স্থানান্তরঃ আইয়ুব খানের সরকার ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের জন্য নতুন একটি সংবিধান রচনা করলে সেটিতে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা বহির্ভূত এলাকা তুলে দিয়ে উপজাতীয় এলাকা সংযােজন করা হয়। ১৯৬৪ সালে সংবিধানে সংশােধনী আনা হয়, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সংশােধনীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সংশােধনীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার উপজাতীয় এলাকা হিসেবে বিশেষ ব্যবস্থা তুলে দেয়ার প্রস্তাব করা হলে জাতীয় পরিষদে তা পাস হয়ে যায়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় এ বিশেষ বিধান মানা হয়নি। ফলে সচেতন উপজাতি জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়। আবার দলে দলে দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারত ও বার্মায় আশ্রয় নেয় (সিদ্ধার্থ চাকমা)।

(৪) পার্বত্য অঞ্চলে অ-উপজাতি লােকদের অনুপ্রবেশ এবং তাদের ৪ দফা দাবীঃ ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অ-উপজাতি অনুপ্রবেশের কতিপয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, যা উপজাতিদের স্বতন্ত্রে আঘাত হানে। এবং উপজাতিরা স্বতন্ত্র রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে থাকে এবং শেখ মুজিবের সময় ১৯৭২ সালের মে মাসে মং রাজা মং প্রু চাই- এর নেতৃত্বে চার দফা দাবি নিয়ে সাক্ষাৎ করতে দপ্তরে যান। দাবিগুলাে নিম্নরূপ-

(১) পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
(২)উপজাতীয় জনগণের অধিকারে সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালের রেগুলেশন ১-এর মতাে অনুরূপ বিধি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে কোনাে শাসনতান্ত্রিক সংশােধন বা পরিবর্তন যেন না হয় এরূপ বিধিব্যবস্থা সংবিধানে থাকবে।
(৪) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ করা হবে।

(৫) উপজাতিদের জাতিসত্তায় হস্তক্ষেপ/পার্বত্য আদিবাসীকে বাঙালি আখ্যাঃ উপজাতীয় রাজনীতির ১৯৭৩ সালে রাঙামাটিতে একটি জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র আদিবাসীকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করলে উপজাতীয় সচেতন মহল অনুধাবন করে যে, জাতিগতভাবে তাদের অস্তিত্ব বিলােপ করে দেবার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে পুঁজি করে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র জনগণকে মুক্তি সংগ্রামে একত্রিত হওয়ার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকে।

(৬) জনসংহতি সমিতি ও শান্তি বাহিনীঃ উপজাতি রাজনীতি মানবেন্দ্র লারমা উপজাতীয় যুবক এবং শিক্ষিত শ্রেণিকে সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৭২ সালের মে মাসে জনসভা এবং সেখান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি দল আত্মপ্রকাশ করে, যার প্রধান ছিলেন রিফেরােয়াজা। মানবেন্দ্র লারমা এই বলে উপজাতীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন যে, আমাদের পৃথক জাতিসত্তা হুমকির সম্মুখীন। আমরা আমাদের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতাে বিস্ফোরিত হতে থাকে তার এই স্লোগান।

(৭) পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও তার বাস্তবায়নঃ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি হলাে উপজাতীয় শান্তিচুক্তি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। প্রধানত ১৯৯৬ সালে ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঐ বছরের ৩০ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সমিতি গঠন করা হয়। এ কমিটির সরকার পক্ষের প্রধান হন তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিপ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান হন সন্তু লারমা। এ উভয় পক্ষ বিভিন্ন সেমিনার, আলােচনা সভা করতে থাকে। ২৫ জানুয়ারি ৯৭ থেকে পরবর্তী দশ মাসে তারা অত্যন্ত মূল্যবান ছয়টি বৈঠক করে। অবশেষে খসড়া চুক্তির আলােকে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ রােজ মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকাতে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলােচিত পার্বত্য শান্তিচুক্তি। এ পার্বত্য মান্তিচুক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

(৮) আদিবাসী ফোরাম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ বাংলাদেশে উপজাতীয় জনগােষ্ঠির রাজনৈতিক আচরণের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হল বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠন। এ ফোরামটি ২০০১ সালে ১৩ জুলাই গঠিত হয়। সাধারণত কেবলমাত্র মানবাধিকারই নয়, মানুষের মৌলিক অধিকার থেকে চিরবঞ্চিত আদিবাসীদের মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্য, সংহতি ও প্রগতি এ মূলনীতিকে নিয়ে এ ফোরামের মাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও সংহতি জোরদার করা এবং প্রগতির পথে এগিয়ে নেওয়াই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলতে পারি যে, পাহাড়ি এবং সমতলের জনগণের মধ্যে যে লড়াই তা মূলত উপজাতিদের অধিকার আদায়ের লড়াই এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে, যেমনঃ পার্বত্য শান্তিচুক্তি। আর তাদের জাতিসত্তা রক্ষায় তারা যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছে আদিবাসী ফোরাম তার মধ্যে অন্যতম এবং অধিকার বাস্তবায়নে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক