রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা ব্যাখ্যা কর। 
অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ প্লেটো ও এরিস্টটল উভয়েই বিশ্বাস করতেন যে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ হচ্ছে রাজনৈতিক জীব। ব্যক্তির অর্থনৈতিক প্রয়ােজন সামাজিক প্রবণতার মাঝেই তিনি রাষ্ট্র উৎপত্তির কারণ নির্দেশ করেছেন। সামন্ত প্রথার প্রয়ােজনের তাগিদে একদিকে পুরুষ ও নারী এবং অন্যদিকে প্রভু ও ভৃত্য একত্রে বাস করে প্রথমে একটি পরিবার গঠন করেছে। কিন্তু একসময়ে দেখা গেল যে একটি পারিবারিক কাঠামাের মাঝে উন্নত জীবন সম্ভবপর নয়, তখন সামন্ত পরিবার একটি গ্রাম্য সংগঠনে একত্রিত হয়ে ক্রমান্বয়ে একটি নগর রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে। সাংগঠনিক দিক থেকে রাষ্ট্র হচ্ছে মানুষের একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সর্বাধিক নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও বস্তুগত কল্যাণ সাধন করা।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ এরিস্টটল তার The Politics গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানঃ এরিস্টটলের মতে, মনুষ্য প্রকৃতির বিবর্তনের মধ্যে রাষ্ট্রের জন্ম নিহিত। তিনি বলেছেন, প্রকৃতিক বা স্বাভাবিক উপায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, The state is a creation of nature. অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রকৃতিরই অবদান।

(২) সংঘবদ্ধ ঐক্যবােধঃ এরিস্টটল বলেছেন, মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনের প্রথম প্রকাশ ঘটে পরিবার গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু যখন পরিবার সদস্যদের চাহিদা মেটাতে পারে না তখন সৃষ্টি হয় গ্রামের। আর গ্রাম যখন চাহিদা মেটাতে পারে না তখন সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের।

(৩) উন্নত জীবনের চেতনায়ঃ উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। এরিস্টটলের মতে, মানুষ ভালভাবে বাঁচতে চায়। সুষ্ঠু আকাঙ্খা পূরণের জন্যই মানুষ সমাজবদ্ধ হয় এবং রাষ্ট্র গঠন করে। সুতরাং এরিস্টটলের মতে উন্নত জীবনযাপনের চেতনা থেকেই রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।

(৪) মানুষের সহজাত সমাজপ্রবণতাঃ এরিস্টটলের মতে, মানুষের সহজাত প্রবণতা তাকে রাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট করে তােলে। তাছাড়া রাষ্ট্রের মধ্যেই ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশ সম্ভব। তাই তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সমাজে বসবাস করে না সে হয় পশু না হয় দেবতা।

(৫) চাহিদা ও নিঃসঙ্গতা দূরীকরণার্থেঃ এরিস্টটল বলেন, মানুষের চাহিদাসমূহ পূরণের জন্য প্রয়ােজন অপরের সাহায্য-সহযােগিতা। তাই নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য এবং চাহিদা পূরণ করার জন্য মানুষ সংঘবদ্ধ হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র গঠিত হয়। আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রসমূহ একটি আপােষ চুক্তিমূলে আবদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্র গড়ে তােলে।

(৬) নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল জীবনের প্রত্যাশায়ঃ নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করেছে। সমাজের সকল মানুষ সব দিক দিয়ে সমান নয়। কেউ সরল, কেউ দূর্বল, কেউ সচ্ছল আবার কেউ অসছিল। সুতরাং এই ভারসাম্যহীন সমাজব্যবস্থায় নির্দিষ্ট নিয়ামক ছাড়া শান্তি আশা করা যায় না। আর শান্তির অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে একটি সার্বভৌম শক্তি, এই সার্বভৌম শক্তিই রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

(৭) সীমিত সংখ্যক অধিবাসীঃ এরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের জনসংখ্যা হবে সীমিত যাতে করে রাষ্ট্রের নাগরিকরা পরস্পরকে চিনতে পারে। আর এতে করে নাগরিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে।

(৮) আয়তনঃ এরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের আয়তন এমন হবে যাতে জনগণ ভালােভাবে বসবাস করতে পারে। রাষ্ট্রের আয়তন বেশি হলে রাষ্ট্রে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রের আয়তন যত বেশি হয় শক্তি তত কম হয়। তাই রাষ্ট্রের আয়তন কম হওয়া উচিত।

(৯) রাষ্ট্রের অবস্থানঃ এরিস্টটলের মতে, ভৌগােলিক অবস্থানের দিক দিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি। এতে ব্যবসা বাণিজ্যের অনেক সুবিধা হবে এবং নৌবহর দ্বারা বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ করা সম্ভবপর হবে।

(১০) নাতিশীতােষ্ণ আবহাওয়াঃ জলবায়ু নাতিশীতােষ্ণ আবহাওয়া ও জলবায়ু মানুষের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপযােগী হওয়ায় এরিস্টটল এরূপ অঞ্চলে রাষ্ট্রের অবস্থান হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষের জীবনাদর্শের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য রাষ্ট্র এক অপরিহার্য সংঘ। মানুষের প্রয়ােজনেই এর উদ্ভব। এরিস্টটল ১৫৮ টি রাষ্ট্রের সংবিধান পর্যালােচনা করে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তার মতে, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে সমাজে আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা, নাগরিকদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, শাসনতন্ত্র অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা এবং উত্তম জীবনের প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক