অথবা, ঘটনা উল্লেখপূর্বক জঙ্গে জামাল তথা উষ্ট্রের যুদ্ধ সম্বন্ধে যা জান লেখ।
উপস্থাপনাঃ ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা)-এর খেলাফত আমলে পর পর তিনটি ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা ইসলামের ঐক্য সংহতি ও গৌরবময় ইতিহাস বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তন্মধ্যে জঙ্গে জামাল, বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ উষ্ট্রের যুদ্ধই ছিল ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গৃহযুদ্ধ। এ যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন,Thus came to an end the first, but by no means the last, encounter in which Muslim stool against Muslim in battle array. (History of the Arab: P-180)
নামকরণঃ এ যুদ্ধে হযরত আয়েশা (রা) উষ্ট্রে আরােহণ করে সৈন্য ও যুদ্ধ না পরিচালনা করেছিলেন বলে এ যুদ্ধ ইতিহাসে উষ্ট্রের যুদ্ধ বা Butle of Camel নামে পরিচিত।
উষ্ট্রের যুদ্ধের কারণঃ নিম্নে উষ্ট্রের যুদ্ধের কারণ ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো-
১. তালহা ও যুবায়েরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক মােকাবিলা এবং সমস্যা সমাধানে হযরত তালহা ও যুবায়ের (রা)-এর প্রস্তাব গুরুত্ব না পাওয়ায় তারা খলিফা হযরত আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
২. হযরত আয়েশার চিন্তাগত ভূলঃ খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতই জঙ্গে জামাল তথা উষ্ট্রের যুদ্ধের পটভূমি রচনা করে। এ দুঃখজনক ঘটনার সময় হযরত আয়েশা (রা) হজ্জ উপলক্ষে মক্কা শরীফে ছিলেন। তাই এ ঘটনার খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অনবহিত। এ অবস্থায় তাকে হযরত আলী (রা) সম্পর্কে ভুল বুঝানাে হয়। তিনিও সে ভুলের শিকার হন।
৩. হযরত আলী (রা)-এর নীতির সমালােচনাঃ হযরত আয়েশা (রা) রাষ্ট্র পরিচালনায় আলী (রা)-এর অনুসৃত নীতি পছন্দ করতেন না। অনেকে এ সুযােগের সদ্ব্যবহার করে আয়েশা (রা)-কে আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে নানা কথা বুঝাতে থাকে। হযরত আয়েশা (রা)-ও সরল বিশ্বাসে এসব কথার গুরুত্ব দেন। এটাই উষ্ট্রের যুদ্ধের অন্যতম কারণ।
৪. তালহা ও যুবায়েরের বিরােধিতাঃ হযরত তালহা ও যুবায়ের (রা) হযরত আলীর নিকট ওসমান হত্যার বিচারের দাবি জানালে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে হযরত আলী (রা) তাদের দাবি অনুযায়ী ভাৎক্ষণিক বিচার করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এতে তালহা ও যুবায়ের (রা) প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।
৫. ঐতিহাসিকদের ভ্রান্ত অপবাদঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী, মাসুদী, হিট্টি ও মুইরের মতে, হযরত তালহা, হযরত যুবায়ের ও হযরত আয়েশা (রা) খেলাফতের প্রত্যাশায় হযরত আলীর বিরােধিতা করেন। মূলত ঐতিহাসিকদের অরােপিত কল্পিত এ অপবাদ থেকে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ পূত পবিত্র।
৩. মুয়াবিয়া (রা) কর্তৃক ওসমান হত্যার বিচার দাবিঃ আমীরে মুয়াবিয়া (রা) হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করেন, কিন্তু এর কোনাে প্রস্তুতি না দেখে তিনি তার দলবলসহ হযরত আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে বিরােধিতা শুরু করেন।
উষ্ট্রের যুদ্ধের ঘটনাঃ নিম্নে উষ্ট্রের যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো-
১. শান্তি আলােচনাঃ ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত তালহা, যুবায়ের ও আয়েশা (রা) ৬০০০ সৈন্য নিয়ে বসরায় গমন করে ওসমান হত্যায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। এ সময় আলী (রা) ও তাদের মধ্যে শান্তি আলােচনার পর উভয়পক্ষ সমঝােতায় আসেন।
২. যুদ্ধের সূচনাঃ শান্তি আলােচনার অগ্রগতি দেখে হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যা ঘটনার মূলনায়ক আবদুল্লাহ ইবনে সাবা বুঝতে পারল, যদি উভয় দলের মধ্যে। সমঝোতা হয়ে যায় তাহলে তাদের হত্যা করা হবে। তাই উভয় দলের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করার জন্য তার দল রাতের অন্ধকারে তালহা, যুবায়ের ও আয়েশার বাহিনীকে আক্রমণ করে। ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। হযরত আয়েশা (রা) উষ্ট্রের পৃষ্ঠে আরােহণ করে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে হযরত আলী (রা)-ই জয় লাভ করেন। হযরত আলী (রা) যথাযথ সম্মান সহকারে হযরত আয়েশা (রা)-কে মদিনায় পৌঁছে দেন।
যুদ্ধের ফলাফলঃ নিম্নে উষ্ট্রের যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো-
১. প্রথম গৃহযুদ্ধঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, উষ্ট্রের যুদ্ধ মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম গৃহযুদ্ধ। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর বলেন, এ যুদ্ধেই মুসলমানগণ সর্বপ্রথম একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে।
২. অসংখ্য মুসলমানের প্রাণনাশঃ এ যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার মুসলমান প্রাণ হারায় এবং হযরত আয়েশা (রা) বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তার নিরাপত্তা রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় চার হাজার সাতশ সৈন্য নিহত হয়।
৩. ইসলামী ঐক্য সংহতির বিপুল ক্ষতিঃ এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ইসলামের ঐক্য সংহতির গৌরবময় ইতিহাসের বিপুল ক্ষতি সাধন করে।
৪. গৃহযুদ্ধের সূচনাঃ উষ্ট্রের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনাকারী হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে সিফফিনের যুদ্ধসহ অন্যান্য গৃহযুদ্ধ উষ্ট্রের যুদ্ধেরই প্রতিফল।০
৫. গােত্রীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টিঃ উষ্ট্রের যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের মধ্যে গােত্রীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টি হয়। ফলে পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনেক বিরূপ মন্তব্য করার সুযােগ পান।
৬. অনৈক্যের সূচনাঃ এ যুদ্ধ মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
৭. হযরত আলী (রা)-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ উষ্ট্রের যুদ্ধের ফলে বসরা ও কুফায় হযরত আলী (রা)-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮. প্রশাসনিক পরিবর্তনঃ বিদ্রোহ সমূলে উৎপাটন করার জন্য হযরত আলী (রা) প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি কায়স ইবনে সাদ, সাহল ইবনে হােনায়ফ ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে যথাক্রমে মিসর, হেজায ও বসরার শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন।
৯. রাজধানী স্থানান্তরঃ খলিফা হযরত আলী (রা)-এর অন্যতম প্রশাসনিক পদক্ষেপ হলাে মদিনা থেকে রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করা। ঐতিহাসিক মুইর বলেন, উষ্ট্রের যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন।
১০. মদিনার কর্তৃত্ব হ্রাসঃ উষ্ট্রের যুদ্ধের পর রাজধানী কুফায় স্থানান্তরিত হওয়ায় রাসূল (স) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনার গুরুত্ব অনেকাংশে কমে যায়।
১১. মদিনাবাসীর অনুভূতিতে আঘাতঃ রাজধানী স্থানান্তরের ফলে মদিনাবাসীর অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং খলিফা হযরত আলী (রা) তাদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতা ও সমর্থনলাভে ব্যর্থ হন।
১২. ষড়যন্ত্র ও আনুগত্যহীনতা উৎখাতের প্রচেষ্টাঃ ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন, এ যুদ্ধের ফলে সকল প্রকার ষড়যন্ত্র ও আনুগত্যহীনতা উৎখাতের নিমিত্ত প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করা হয়।
১৩. ভুল বুঝাবুঝির অবসানঃ হযরত ওসমান হত্যাকারীদের উসকানি ও প্ররােচনায় হযরত আলী (রা) ও হযরত আয়েশার (রা) মধ্যে যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল, উষ্টের যুদ্ধে হযরত আলী (রা)-এর বিজয়ের মাধ্যমে সে ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে।
উপসংহারঃ উষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গৃহযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল ভুল বুঝাবুঝির কুফল। এ যুদ্ধের ফলে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সংহতি চিরতরে বিনষ্ট হয়ে পড়ে এবং পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষী ঐতিহাসিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য উত্থাপনের সুযােগ পেয়ে যান।
0 মন্তব্যসমূহ