অথবা, সামাজিক গবেষণার প্রকৃতি ও পরিধি বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের তত্ত্ব গঠনের উদ্দেশ্যে যেসব গবেষণা কাজ পরিচালিত হয় সেগুলােকেই সাধারণ কথায় সামাজিক গবেষণা বলা যেতে পারে। সামাজিক গবেষণা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সমাজ তথা সামাজিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসাবে কাজ করে চলেছে। সমাজ সম্পর্কিত বিষয়গুলােকে সামাজিক বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে গবেষণার কোনাে বিকল্প নেই। বৈজ্ঞানিক জগত সাধারণত সুপরিকল্পনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে, তাই কোনাে কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সামাজিক গবেষণার কোনাে বিকল্প নেই। সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তাই সামাজিক গবেষণা বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে আলােচিত হচ্ছে।
গবেষণার প্রকৃতি (Nature of Research): উদ্দেশ্যগতভাবে যেকোনাে গবেষণাই নতুন জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে উপস্থিত জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে তথ্য তত্ত্ব গঠনে আগ্রহী। এর পেছনে অবশ্য কাজ করে গবেষকের অনুসন্ধিৎসু বা কৌতুহলী মন এবং সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ উদ্ভাবন প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে গবেষনালব্ধ ফলাফল বিভিন্ন আংগিকে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ দৃষ্টিকে সামনে রেখে বিজ্ঞানীগণ গবেষণাকে দু'টো ভাগে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন- (১) মৌলিক গবেষণা (২) ফলিত গবেষণা। এছাড়াও বর্তমান কালে বিজ্ঞানীগণ আরও এক ধরনের গবেষনার কথা উল্লেখ করে থাকেন। তাহলাে- (৩) কার্যক্রম গবেষণা।
মৌলিক গবেষণা (Basic Research): মৌলিক গবেষণাকে অনেকসময় Pure Research, Fundamental Research ইত্যাদি নামেও উল্লেখ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলাে বিশ্বের বিভিন্ন মৌলিক নীতি ও সত্য আবিস্কার করা। এ নীতিতে মৌলিক গবেষণা সুদৃঢ়ভাবে কেবল তত্ত্বের পরীক্ষাও উন্নয়ণ ঘটিয়ে থাকে মাত্র। এর তাৎক্ষণিক কোনাে ব্যবহার প্রত্যাশা থাকে না। পরবর্তীতে অথবা পরােক্ষভাবে এর ব্যবহার হতে পারে এ বিষয়ে মৌলিক গবেষণার কোনাে প্রকার ঝোক প্রবণতা থাকে। এ সমস্ত কারণে মৌলিক গবেষণায় গবেষক প্রাপ্ত তত্ত্বের ব্যবহার উপযােগিতার পরিবর্তে এর নিয়ন্ত্রণ ও যথার্থতার প্রতি কেবল গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এসব গবেষণা প্রধানত গবেষণাগারেই হয়ে থাকে। পাশাপাশি আচরণগত ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী মানুষের পরিবর্তে প্রাণীদের ব্যবহার করে থাকেন যাতে করে এখানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভবপর হয়।
ফলিত গবেষণা (Applied Research): ফলিত গবেষণাকে মাঠ গবেষণাও বলা হয়ে থাকে। এ গবেষণার মূল লক্ষ্যই হলাে প্রাপ্ত তথ্যকে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণ করা এবং প্রয়ােগ করা। মৌলিক গবেষণার মত এখানে নিয়ন্ত্রণ ও যথার্থতার প্রতি কম গুরুত্ব দিয়ে বরঞ্চ প্রায়ােগিক দিকেই বেশি জোর দেয়া হয়। বস্তুত বাস্তব সমস্যা সমাধান, উন্নয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়ােজনীয় সমস্যা, চাহিদা, সম্পদ, প্রক্রিয়া এ লাভক্ষতি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যাবলি সংগ্রহ করা এবং কার্যকারণ সম্পর্ক যাচাই করা সম্ভব হয়ে থাকে ফলিত গবেষণার মাধ্যমে।
কার্যক্রম গবেষণা (Action Research): ফলিত গবেষণার মাধ্যমে গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচির কার্যকারিতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্যে তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুততার সংগে যেসমস্ত গবেষণা করা হয়, তাকেই মূলত কার্যক্রম গবেষণা বলে আখ্যায়িত করা যায়। সংগত কারণে এখানে সংশােধনের জন্য প্রয়ােজনীয় আর্থিক বিভাজন তুলে ধরা হয়। ফলিত গবেষণার সংগে এরূপ গবেষণার পার্থক্য হলাে- কার্যক্রম গবেষণায় বাস্তবতার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এখানে সাধারণের পরিবর্তে কর্মসূচির বিশেষ বিশেষ দিকের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা হয়।
সামাজিক গবেষণার উদ্দেশ্যসমূহঃ নিম্নে সামাজিক গবেষণার উদ্দেশ্যসমূহ তুলে ধরা হলাে:
(১) সামাজিক সমস্যা সমাধানঃ আধুনিক সমাজ নানা ধরনের সমস্যায় আবৃত। যেমন: জনসংখ্যা সমস্যা, খাদ্য ঘাটতি, বেকারত্ব, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন ইত্যাদি। এসব সামাজিক সমস্যার সমাধান সাধনই সামাজিক গবেষণার মুখ্য উদ্দেশ্য।
(২) অনুসন্ধান পদ্ধতির উন্নয়নঃ সামাজিক গবেষণার আর একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলাে অনুসন্ধান পদ্ধতির উন্নয়ন। সমাজবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাবলি সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেন সেসব পদ্ধতির সবগুলােই সব ধরনের সমস্যার জন্য উপযুক্ত নয়। প্রত্যেকটি পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তাই সমাজবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করার উপযুক্ত ও ত্রুটিমুক্ত পদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য গবেষণা কার্য সম্পাদন করে থাকেন।
(৩) সত্য উদঘাটন করাঃ সামাজিক গবেষণা বর্তমান এবং অতীত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে পর্যালােচনা করে ভবিষ্যৎ সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা প্রদান করে। সামাজিক গবেষণার উদ্দেশ্য হলাে সত্য উদঘাটন। তাই এ ধরনের গবেষণা সঠিক তত্ত্ব গঠন করে এবং ভ্রান্ত তত্ত্ব পরিহার করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
(৪) কার্যকারণ সম্পৰ্ক আবিস্কার করাঃ সামাজিক গবেষণার একটি উদ্দেশ্য হলাে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে যােগসুত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং কার্যকারণ সম্পর্ক আবিস্কার করা। সামাজিক গবেষকগণ আবিষ্কার করেন, কোনাে ধরনের সামাজিক অবস্থা কোন ধরনের সামাজিক আচরণ সৃষ্টি করে। গবেষকগণ এসব জ্ঞান থেকে ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে। কোনাে ধরনের পরিবর্তন ঘটবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন।
(৫) সম্প্রীতি ও সদ্ভাব সৃষ্টি করাঃ সামাজিক গবেষণার আর একটি উদ্দেশ্য হলাে বিভিন্ন জাতি বা গােষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব সৃষ্টি করা। কেননা, এর দ্বারা পৃথিবীতে অবারিত শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে সামাজিক বিজ্ঞানের প্রকৃতি আলােচনায় বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, সামাজিক গবেষণার প্রকৃতি গবেষণার শর্ত এবং সাবধানতা হিসেবে কাজ করে। সামাজিক গবেষণার স্বরূপের ওপর ভিত্তি করে দিন দিন সামাজিক উদ্দেশ্যের ক্ষেত্র বিস্তৃতি লাভ করেছে।
0 মন্তব্যসমূহ