পােপতন্ত্র কাকে বলে? পােপতন্ত্রের উদ্ভব ও রােমান ক্যাথলিক চার্চের প্রাধান্য লাভের কারণ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ পােপতন্ত্র কাকে বলে? পােপতন্ত্রের উদ্ভব ও রােমান ক্যাথলিক চার্চের প্রাধান্য লাভের কারণ আলােচনা কর।

অথবা, পােপতন্ত্র বলতে কী বুঝ? পােপতন্ত্রের উদ্ভব ও রােমান ক্যাথলিক চার্চের প্রাধান্য লাভের কারণসমূহ বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ ল্যাটিন শব্দ PAPA থেকে PAPATIA এবং তা থেকে ইংরেজি ভাষায় PAPACY শব্দের উদ্ভব হয়। খ্রিস্ট ধর্মের প্রধান তিনটি ধারার মধ্যে অন্যতম ও বৃহত্তম শাখা রােমান ক্যাথলিক চার্চকে ঘিরেই পােপতন্ত্র বা রােমের চার্চ প্রধান যিনি পােপ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। রােমান ক্যাথলিক চার্চ তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে। এভাবে রােম চার্চের সর্বময় কর্তা পােপ ধর্মনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব পরিচালনা করেন তাকেই পােপতন্ত্র বলে ।

(১) খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক অবস্থাঃ খ্রিস্ট ধর্মের দু’শত বছর এই ধর্ম ছিল সহজ সরল। রােমান সাম্রাজ্যের নিষ্ঠুর অমানবিক দাসপ্রথাভিত্তিক সমাজ কাঠামাে ও পৌত্তলিক পূজা অর্চনা ও বলিদানের বিপরীতে মানবতা মৈত্রী ও শক্তির বাণী সমৃদ্ধ খ্রিস্টধর্ম সাম্রাজ্যের নির্যাতিত শ্রেণির কাছে মুক্তির বাণী হয়ে আসে। রােমান বা খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি দমন নীতি গ্রহণ করে। যীশুর মৃত্যুর পর তা চার শিষ্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খ্রিস্ট ধর্ম ধীরে ধীরে প্রচার ও প্রসার লাভ করে।

(২) রােমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্মঃ খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মচারণ ও চর্চার ক্ষেত্রে চার্চের তেমন গুরুত্ব ছিল না ও সেভাবে এটা গড়ে ওঠেনি। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে রােমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচারের অধিকার প্রদান করা হয়। ফলে খ্রিস্টানদের প্রভাব উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে রােমান সম্রাট খ্রিস্ট ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। খ্রিস্টধর্মের চতুর্থ দশকের শেষ নাগাদ রােমান থিও জেসিয়াস-এর রাষ্ট্রীয় ঘােষণা বলে খ্রিস্টধর্মের রােমান সাম্রাজ্যের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ধর্মের অভিসিক্ত করেন। ফলে দলে দলে লােক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে থাকে।

(৩) জাগতিক মােহে খ্রিস্টধর্মঃ এদের অধিকাংশই খ্রিস্টধর্মের অন্তর্নিহিত বাণী অপেক্ষা রাষ্ট্রকে পৃষ্ঠপােষকতা ও অন্যান্য সুযােগ লাভের জাগতিক মােহ ধর্মান্তরিত হয়। খ্রিস্ট ধর্মের এই ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন প্রচলিত লােক বিশ্বাস, প্রথা আচার-অনুষ্ঠান প্রবেশ করতে থাকে। খ্রিস্টধর্মের আদিরূপ খর্ব হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে ধর্মনৈতিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীয় কাঠামাের নিয়ন্ত্রণ আরােপ দরকার হয়ে পড়ে।

(৪) রােমান চার্চের নিয়ন্ত্রণঃ প্রাথমিক পর্যায়ে খ্রিস্টধর্মের প্রার্থনার পর্যায় ছিল ব্যক্তিতত্ত্বঈশ্বর ও প্রার্থনাকারী মধ্যকার যােগাযােগ ছিল সরাসরি। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সাথে সাথে গুরুত্ব বাড়তে থাকে। রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি লাভের পর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবকাঠামাের যাজকরা ক্রমেই প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদা অর্জনে সমর্থ হয়। সর্বোপরি চার্চ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় বিভিন্ন ও উৎস থেকে অর্থ লাভ করে এবং শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি অর্জন করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চার্চগুলাে আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের মধ্যে ধর্মপালন হেতু ও সামাজিক প্রথা হিসেবে নির্দেশিত চার্চে গমনের অভ্যাস গড়ে ওঠে। আবার প্রত্যেক খ্রিস্টানকেই কোনাে না কোনাে ধর্মের সফলতা থাকতে হয়। এসব চার্চকে আবার নিয়ন্ত্রণ করত রােমান চার্চ।

(৫) পােপতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাঃ মধ্যযুগ নগরের উদ্ভব ও প্রাধান্য বিস্তারের সাথে সাথে গ্রামীণ চার্চগুলাে গণহারে চার্চের অধীন হয়ে পড়ে। এর প্রধান ছিল ড্রেসবাইটার। এই চার্চগুলাে জেলার দায়িত্বেনিযুক্ত বিভাগের অধীন ছিল। কয়েকটা জেলা নিয়ে একটা প্রদেশ গঠিত হতাে যার দায়িত্বে থাকতেন চার্চবিভাগ। কয়েকটি বিভাগ নিয়ে গঠিত হতাে একটা প্যাট্রিয়া বাের্ড। প্রাথমিক পর্যায়ে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের পাঁচটি সমমর্যাদাসম্পন্ন প্যাটিয়া ফেট ছিল। এগুলাে হল- (১) রােম, (২) কনসন্টিনটেশন, (৩) জেরুজালেম, (৪) এ্যান্টিটয়ক, (৫) আলেকজান্দ্রিয়া।

(৭) পােপের প্রভাব বিস্তারঃ প্রাচীন রােম সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে রােম ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আবার রােম ছিল প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। সমুদ্র পশ্চিমে এর মতাে বৃহৎ প্রাচীন সমৃদ্ধশালী শহর আর ছিল না। তৃতীয় শতাব্দী নাগাদ রােম সমস্ত চার্চের আনুগত্য দাবি করে। পােপ ক্রমে ক্রমে স্পেন পল উত্তর আফ্রিকা এশিয়া চার্চসমূহের প্রভাব বিস্তার করে।

(৮) কনস্টান্টিনােপলে রাজধানী স্থাপনঃ রােমান সম্রাট কনস্টান্টিনােপল, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য দখল করে কনস্টান্টিনােপলে ৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করে এবং শাসনকার্য সম্পাদন হেতু বছরের কিছুসময় সেখানে অবস্থান করতে বাধ্য হতেন। এ অবস্থায় রােম সম্রাটের অনুপস্থিতিতে পােপের মর্যাদা আরাে বৃদ্ধি পায় এবং রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে খ্রিস্টধর্মের সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হতাে। কনস্টান্টিনােপলে রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর প্রাচ্যের কিছু চার্চ প্রধান ঘােষণা দেন যে, রােম ও কনস্টান্টিনােপল একই অপরাধে অপরাধী।

(৯) রােমের প্রাধান্য অব্যাহতঃ যদিও ৪৪৫ সালে সম্রাট প্যালেস্টাইনে সবাইকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে পােপের নির্দেশ মেনে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন, তথাপি পূর্ব-পশ্চিমের বিষয়টি অব্যাহত থাকে। অবশ্য কালক্রমে পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিক অন্টোভেল চার্চ মুসলিম অগ্রাভিযানের মুখে কনস্টান্টিনােপল থেকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে তার কেন্দ্র স্থাপন করেন।

(১০) পােপ প্রথম গ্রেগরিঃ ৫৯০-৬০৪ খ্রিস্টাব্দে পােপতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে যিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি হলেন পােপ প্রথম গ্রেগরি। তিনি ছিলেন একাধারে দক্ষ ধর্মজ্ঞ, সঙ্গীত বিশারদ ও দক্ষ প্রশাসক। তৎকালীন বিশ্বে তিনি যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিলেন। তার সময় পােপদের বলা হতাে ঈশ্বরের সেবকদের সেবক। মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ দেখানােই ছিল তার একমাত্র সাধনা।

(১১) পােপ প্রথম লিজাঃ পােপ প্রথম লিজা পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি উপজাতির আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খল অবস্থা যখন বিরাজিত ছিল সর্বত্র তখন তিনি দৃঢ়ভাবে রােমের অধিকার প্রতিষ্ঠিত রাখেন। ৪৭৬ সালে পশ্চিম সাম্রাজ্য রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে পােপতন্ত্র এভাবে এক ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করায় রােম সাম্রাজ্যের পতনের আঘাত সহ্য করে পােপ পৃথিবীর উত্তরসূরি হিসেবে খ্রিস্টানদের অন্তরে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। তা ছাড়া রােমান ক্যাথলিকদের সামাজিক ঐক্যের বন্ধন প্রতীক হিসেবেও রােমানরা চার্চকে গ্রহণ করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক