কাদেসিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর


প্রশ্নঃ কাদেসিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।
অথবা, কাদেসিয়ার যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব সম্বন্ধে তােমার নিজের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ কর।
অথবা, কাদেসিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে যা জান লেখ।


উপস্থাপনাঃ ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর খেলাফতকালে মুসলিম মুজাহিদগণ যে বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন, তারই ধারাবাহিকতায় পারস্য সাম্রাজ্য মুসলমানদের করতলগত হয়। আর পারস্য বিজয়াভিযানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাদেসিয়ার যুদ্ধ। মূলত এ যুদ্ধ ছিল মিথ্যার ওপর সত্যের জয়; এ যুদ্ধে পারসিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে তরবারি ধারণের প্রায় সকল ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে।

কাদেসিয়ার যুদ্ধের কারণঃ
১. পারস্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনঃ
ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, পারস্যের রাজনীতিতে ইতােমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। তখন সাম্রাজ্যের মসনদে আরােহণ করেছেন তৃতীয় ইয়াজদেজর্দ। এ সময় তিনি হৃত রাজ্য পুনর্দখলের জন্য মহাবীর রুস্তমের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ফলে কাদেসিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

২. রুস্তমের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণঃ মুসলমানদের পক্ষ থেকে শান্তির প্রস্তাব দিলে রুস্তম গর্বভরে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলে, সমগ্র আরবের দম্ভ আমি চুর্ণ করে ছাড়ব। এ সময় একজন মুসলিম সৈন্য বলেন, “যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয়।” প্রত্যুত্তরে। রুস্তম বলল, কিছুতেই নয়, খােদার ইচ্ছা না হলেও সবকিছু শেষ করে দিতে পারব।

৩. মুসলিম দূতের অবমাননাঃ শেখ রেয়াজুদ্দীন আহমদ বলেন, পারস্যের দরবারে মুসলিম দূত প্রেরিত হলে সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেজর্দ মুসলিম দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। পারস্যরাজের এহেন অশােভন আচরণ যুদ্ধ ত্বরান্বিত করে।

৪. পারসিকদের প্রতিশােধ গ্রহণঃ বুয়ায়েবের যুদ্ধে শােচনীয় পরাজয় পারসিকরা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাই প্রতিশােধ গ্রহণের নিমিত্ত তারা যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।

৫. ইসলামী সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাঃ হযরত আবু বকর (রা)-এর আমলে বাহরাইনে যখন বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, তখন পারস্যবাসী এ বিদ্রোহ সৃষ্টিতে নানাভাবে সহযােগিতা করায় ইসলামী সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কারণেই মুসলমানগণ এর বিরুদ্ধে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে শুরু করেন।

৬. ভৌগােলিক কারণঃ History of the Surgcens গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ ইরাক ভৌগােলিক বিশ্লেষণে আরবের স্বাভাবিক অংশ ছিল। তাই আরবের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য এ অংশ জয় করতে মুসলমানগণ উৎসাহ বােধ করেন।

৭. অর্থনৈতিক কারণঃ আরবের অধিকাংশ বাণিজ্য ইরাকের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও পারস্যবাসী মুসলিম ব্যবসায়ীদের অবাধে বাণিজ্য করতে দিতে রাজি ছিল না। তাই অর্থনৈতিক প্রয়ােজনেও মুসলমানগণ পারস্য বিজয়ে উদগ্রীব হয়।

৮. সামাজিক রীতির বৈপরীত্যঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী ও ড ইমামুদ্দিন বলেন, পারসিক ও মুসলমানদের সামাজিক রীতিনীতির বৈপরীত্যের কারণেও এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

কাদেসিয়া যুদ্ধের ঘটনাবলিঃ বুয়ায়েবের যুদ্ধে পারস্য বাহিনীর শােচনীয় পরাজয়ের সংবাদে সম্রাট ক্রোধান্বিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে। এদিকে খলিফা ওমর (রা) হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ৩০,০০০ সৈন্যের এক সুসংগঠিত বাহিনী পারস্য অভিমুখে প্রেরণ করেন। পারস্যরাজ ইয়াজদেজর্দও মহাবীর রুস্তমের নেতৃত্বে ১,২০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করলে পারসিক ও মুসলিমদের মধ্যে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রুস্তমসহ বহু পারসিক সৈন্য পরাজিত ও নিহত হলে পারসিকরা সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত হয়ে পলায়ন করে।

কাদেসিয়ার যুদ্ধের ফলাফলঃ
১. দিনের নামকরণঃ
ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, এ যুদ্ধের ফলে তিনটি দিনের নামকরণ হয়। যেমন- প্রথম দিনকে বলা হয় ইয়াওমুল আরমাছ, দ্বিতীয় দিনকে বলা হয় ইয়াওমুল আগওয়াছ এবং তৃতীয় দিনকে বলা হয় ইয়াওমুল উমাম।

২. পারসিকদের মেরুদণ্ডে আঘাতঃ কাদেসিয়ার যুদ্ধে জয়লাভ মূলত পারস্য সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল।

৩. মিথ্যার ওপর সত্যের জয়ঃ কাদেসিয়া যুদ্ধে বিজয়ের ফলে নতুন করে কুরআনের আয়াতের সত্যতা প্রমাণিত হলাে, “সত্য সমাগত আর মিথ্যা দূরীভূত”।

৪. কাঙ্ক্ষিত শাহাদাত লাভঃ ‘মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী’-এ হলাে ইসলামী জেহাদের মূল প্রেরণা। কাদেসিয়া যুদ্ধে আট হাজার মুসলমান শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে জান্নাতী হওয়ার সৌভাগ অর্জন করেন।

৫. ইতিহাসের গতিঃ বিবর্তন ও ঐতিহাসিক মুইর বলেন, কাদেসিয়ার যুদ্ধ পারস্য ও ইসলামের ইতিহাসের মােড় ঘুরিয়ে দেয়। এ যুদ্ধ সাসানীয় সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মধ্য যুগের ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে।

৬. অর্থনৈতিক উন্নতিঃ কাদেসিয়ার যুদ্ধে বিজয়ের পর আরব সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়। যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীমতের মাল, বিশেষত মাদায়েনে পারসিকদের সঞ্চিত বিপুল ধন সম্পদ ও মণিমাণিক্য মুসলমানদের হস্তগত হয়।

৭. মুসলিম আধিপত্যের বিস্তৃতিঃ এ যুদ্ধের ফলে সমগ্র দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য বিস্তৃত হয়।

৮. মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিঃ এ অসম যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

৯. পারস্য বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েঃ কাদেসিয়ার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে বহু দিন পর্যন্ত দুর্গ অবরােধ করে রাখার পর পারস্য বাহিনী বিধ্বস্ত এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে।

১০. উহুদের শিক্ষার বাস্তব প্রয়ােগঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন উহুদ যুদ্ধে মুসলমানগণ যে শিক্ষা লাভ করেছিল, কাদেসিয়ার প্রান্তরে তা বাস্তবে প্রয়ােগ করে।

১১. পারস্য সেনাপতি নিহতঃ পারস্যের গর্ব ছিল কিংবদন্তী সেনাপতি মহাবীর রুস্তম। এ যুদ্ধে সে নিহত হলে পারস্যবাসীর গর্ব ধুলায় মিশে যায়।

১২. সেনাপতি সাদের প্রশংসনীয় কর্তব্যনিষ্ঠাঃ ঐতিহাসিক গােলাম রসূল বলেন, হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) এ যুদ্ধে যে কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয়। দিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

উপসংহারঃ কাদেসিয়ার যুদ্ধ ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অসম যুদ্ধে পারস্য বাহিনী শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং মুসলিম বাহিনী। বিজয় লাভ করে বিশ্ব বিজয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক