অথবা, সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি পর্যালােচনা কর।
উপস্থাপনাঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের বহুবিধ অভিযানের মধ্যে দাক্ষিণাত্য অভিযান একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। মূলত আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ছিল পূর্ববর্তী সম্রাটদের তথা আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতিরই অনুকরণ। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড বলেন- He was following the policy of aggressive imperialisms initiated by Akbar in the 16th century.
দাক্ষিণাত্য নীতির পর্যালােচনাঃ
দাক্ষিণাত্য নীতির কারণসমূহঃ
১. পূর্বপুরুষের নীতি অনুসরণঃ ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ বলেন, আওরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষের নীতি অনুসরণ করে সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রম শুরু করেন। ফলে তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করতে মনস্থ করেন।
২. প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিঃ আকবরের রাজত্বকাল থেকেই দাক্ষিণাত্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন মুসলিম রাজ্য বিজাপুর, গােলকুণ্ডা, আহমদনগর প্রভৃতি মুঘল সার্বভৌমত্বের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল।
৩. কর প্রদানে অস্বীকৃতিঃ ঐশ্বর্যশালী বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা রাজ্য মুঘল সম্রাটদের নিয়মিত কর প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তাই তিনি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কারণে দাক্ষিণাত্যে অভিযান প্রেরণ করেন।
৪ আকবরকে দমনঃ বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে মারাঠা নেতা শম্ভুজী আশ্রয়দান করলে দাক্ষিণাত্যে একটি নতুন রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে তিনি শমীসহ আকবরকে দমন করা একান্ত প্রয়ােজন মনে করেন। এ কারণেও সম্রাট আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করেন।
৫. মারাঠাদের দমনঃ ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ বলেন, দাক্ষিণাত্যের মারাঠা শক্তি মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাদের ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হন।
দাক্ষিণাত্যে অভিযানের বিবরণঃ
১. শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযানঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব যখন বিজাপুরের সাথে যুদ্ধে রত ছিলেন তখন মারাঠা বীর শিবাজী মুঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল অধিকার করে একটি শক্তিশালী মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শিবাজীকে প্রতিরােধ করতে আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রথমে সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারেননি।
২. জয়সিংহকে প্রেরণঃ শিবাজীকে দমন করার জন্য আওরঙ্গজেব পরবর্তীতে দিলার খান ও জয়সিংহকে প্রেরণ করেন। তাদের আক্রমণে পরাজিত হয়ে শিবাজী ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে পুরন্দরে সন্ধি করে ২৩টি অধিকৃত দুর্গ হস্তান্তর করেন।
৩. মারাঠা শক্তির পুনরুত্থানঃ ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী বিদ্রোহ হয়ে হস্তান্তরিত দুর্গগুলাে পুনর্দখলের চেষ্টা করেন। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রায়গড়ের রাজা উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী মৃত্যুমুখে পতিত হন।
৪. স্বয়ং সম্রাটের দাক্ষিণাত্য অভিযানঃ ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজীর মৃত্যুর পর স্বীয় পুত্র শম্বুজী মুঘলদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তােলেন এবং বিদ্রোহী শাহজাদা আকবরকে আশ্রয় দেন। তাই ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করেন।
৫. বিজাপুর জয়ঃ ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব বিজাপুরে অভিযান পরিচালনা করে সহজেই তা দখল করেন। অপরদিকে সিকান্দর আদিল শাহ তার বশ্যতা স্বীকার করেন।
৬. গােলকুণ্ডা জয়ঃ বিজাপুর জয়ের পর আওরঙ্গজেব ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং সেনাবাহিনী পরিচালনা করে গােলকুণ্ডা আক্রমণ করেন। দীর্ঘ আট মাস গােলকুণ্ডার সুরক্ষিত দুর্গ মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করলেও পরিশেষে তারা পরাজিত হয়।
৭. শম্ভুজীকে গ্রেপ্তারঃ বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা বিজয়ের পর আওরঙ্গজেব মারাঠা রাজ্য বিজয়ে তৎপর হন। নবনিযুক্ত মুঘল অধিনায়ক মুকাররম খান শম্ভুজীকে ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে বন্দি করে হত্যা করেন। ফলে রায়গড় দুর্গ মুঘলদের হাতে আসে। এরপর সমগ্র দাক্ষিণাত্য মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফলঃ
১. সাম্রাজ্যের বিশাল বিস্তৃতিঃ দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করে। কাবুল থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর থেকে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
২: রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাঃ দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে সাম্রাজ্যের সীমা এতদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয় যে, একজন শাসকের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে তা শাসন করা সম্ভবপর ছিল না। ফলে উত্তর ও মধ্য ভারতে চরম বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা সৃষ্টি হয়।
৩. অর্থনৈতিক সংকটঃ দীর্ঘ ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তি ও বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে থাকার ফলে রাজকোষ শূন্য হওয়ার উপক্রম হয়।
৪. কেন্দ্রীয় শাসনে শিথিলতাঃ দাক্ষিণাত্যের অবস্থান রাজধানী থেকে দূরে হওয়ায় কেন্দ্রীয় শাসনে চরম শৈথিল্য দেখা দেয়।
৫. সৈন্যদের বিদ্রোহঃ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিশাল সেনাবাহিনীকে নিয়মিত বেতন দেয়া সম্ভব না হলে তাদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
৬. মারাঠাদের বিদ্রোহ অব্যাহতঃ সম্রাট মারাঠা শক্তিকে ধ্বংস করতে পারায় তাদের বিদ্রোহ সবসময় চলতেই থাকে। কারণ শম্ভুজী ও ধনৌজ এ দু’জন দুর্ধর্ষ মারাঠা বীর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে লুটতরাজ ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে রাখত।
৭. কূটনৈতিক বিপর্যয়ঃ আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কেননা মারাঠারা সমূলে ধ্বংস না হওয়ায় পরবর্তীতে তারা বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে জয়ী হয়।
৮. কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশ ব্যাহতঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির পরােক্ষ ফল ছিল কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশ ব্যাহত হওয়া। যুদ্ধবিগ্রহে অজস্র অর্থ ‘ব্যয়ের ফলে কলা ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনাে স্থায়ী নিদর্শন রাখা সম্ভব হয়নি।
৯. মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনাঃ ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতিই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করে। ড. স্মিথ বলেন- The Decan was the grave of his body as well as of his empire.
সমালােচনাঃ দাক্ষিণাত্য নীতির ব্যর্থতার মূলে আওরঙ্গজেব কতটুকু দায়ী তা ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়। তবে একে সম্রাটের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করা হয়। কারণ-
ক. অদূরদর্শিতার পরিচয়ঃ সম্রাট দাক্ষিণাত্যের শিয়া মুসলিম রাজ্যগুলাের সাথে মৈত্রী স্থাপন না করে সেগুলােকে ধ্বংস করে মারাত্মক ভুল করেন।
খ. মারাঠাদের শক্তি বৃদ্ধিঃ সম্রাট বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা দখল করলে, সেখানকার কর্মচ্যুত সেনা সদস্যগণ মারাঠাদের সাথে যােগ দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে।
উপসংহারঃ দীর্ঘকালব্যাপী আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য অভিযান তার অদূরদর্শিতারই পরিচায়ক। কারণ তার দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করে। তাই ভি. এ. স্মিথ বলেন- The Decan, from which he never returned, was the grave of his reputation as well as of his body.
0 মন্তব্যসমূহ