খায়বার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর


প্রশ্নঃ খায়বার যুদ্ধ সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, খায়বার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ইসলামের ইতিহাসে খায়বার একটি চমকপ্রদ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মদিনা থেকে বিতাড়িত ইহুদি সম্প্রদায় আরবের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়ে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তােলে। পরিণতিতে ঐতিহাসিক খায়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

খায়বার পরিচিতিঃ খায়বার শব্দের অর্থ হলাে দুর্গ। সিরিয়া প্রান্তরের এক বিশাল শ্যামল ভূখণ্ডে, মদিনা থেকে অষ্টম মঞ্জিল বা দু’শ মাইল দূরে খায়বার অবস্থিত। এটা ছিল মদিনা থেকে বহিষ্কৃত বিশ্বাসঘাতক ইহুদি সম্প্রদায়ের বাসস্থান এবং শক্তির প্রাণকেন্দ্র। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, খায়বার ছিল বাগবাগিচায় পূর্ণ কৃষিপ্রধান স্থান।

খায়বার যুদ্ধের কারণঃ

১. ইহুদিদের ভুল ধারণাঃ খন্দক যুদ্ধের পর ইহুদিরা মনে করেছিল, কুরাইশরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের পক্ষে এখন আর মদিনা আক্রমণ সম্ভব নয়। অপরদিকে মুসলমানরাও উহুদের যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই উভয় দলকে দুর্বল ভেবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার সুবর্ণ সুযােগ মনে করে ইহুদিরা যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

২. ইহুদিদের দুষ্ট মনােভাব বৃদ্ধিঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, বন কাইনুকা ও বনু নযির গােত্রের ইহুদিরা খায়বারে তাদের জ্ঞাতি ভাইদের সাথে যােগ দেয়ার পর তাদের দুষ্ট মনােভাব আরাে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা দলবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের মনস্থ করে।

৩. মুসলমানদের উত্যক্তকরণঃ ইহুদিরা মদিনা আক্রমণের যাবতীয় গােপন প্রস্তুতি গ্রহণ করে বার বার ছােট ছােট আক্রমণ দ্বারা মুসলমানদের উত্যক্ত করতে থাকে।

৪. মুসলমানদের হত্যা ও জুলুমঃ একবার ইহুদিরা পথিমধ্যে মুসলিম বণিকদের একটি কাফেলা আক্রমণ করে বহু মুসলমানকে হত্যা করে এবং তাদের ধন সম্পদ লুটে নেয়। ফলে মুসলমানদের বাধ্য হয়েই খায়বারের ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়।

৫. অপহরণের প্রতিবাদঃ ইহুদিরা একবার অতর্কিতভাবে মদিনা সীমান্তে হামলা করে মহানবী (স)-এর ২০টি উট ও চারণভূমির রক্ষক হযরত আবু যর (রা)-এর পুত্রকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর প্রতিকারে মহানবী (স) খায়বারে অভিযান প্রেরণ করতে বাধ্য হন।

৬. নির্বাসিত ইহুদিদের ষড়যন্ত্রঃ ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক ইহুদি গােত্র বনু কুরাইযা ও বনু নযির মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খায়বারে আশ্রয় নিয়ে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ কারণে তারা দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ ও অস্ত্র শক্তি বৃদ্ধি করে মদিনা আক্ৰমুণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ফলে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।

৭. ইহুদি নেতার উচ্চাকাঙক্ষাঃ হুয়াই ইবনে আখতাবের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইহুদি নেতা আবু রাফে সাল্লাম মদিনার নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করে তার শাসন কায়েম করার স্বপ্ন লালন করতে থাকে। ফলে সে খায়বারকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী সকল গােত্রকে নিয়ে ইসলামবিরােধী একটি শক্তিশালী সাম্প্রদায়িক জোট গড়ে তােলে।

৮. বনু গাতফান ও বনু ফারার লুটতরাজঃ খায়বারের ইহুদিরা বনু গাতফানকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে যুদ্ধে উসকে দেয়ার চেষ্টা করে। গাতফান গােত্রের বাহুবল ছিল বনু ফাযারা। এ সম্প্রদায় খায়বারে এসে যুদ্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এদিকে গাতফান কবিলার লুটতরাজ পরিস্থিতি গুরুতর করে তােলে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করতে শুরু করে।

৯. মুনাফিকদের প্ররােচনাঃ মদিনায় বসবাসকারী মুনাফিকদের প্ররােচনা খায়বার যুদ্ধের অন্যতম কারণ। মদিনার মুনাফিকরা ইহুদিদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর নেতৃত্বে মুনাফিকরা মুসলমানদের সব গোপন সংবাদ পরিবেশন করে ইহুদিদের উত্তেজিত করে তােলে। রাসূল (স) ইহুদিদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

খায়বার যুদ্ধের ঘটনাঃ

১. রণাঙ্গনে যাত্রা ও নির্বাসিত ইহুদিঃ তাদের মিত্রদের সহযােগিতায় ৪০০০ সেনাবাহিনীর যুদ্ধপ্রস্তুতির সংবাদ গুপ্তচরের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে মহানবী (স) হিজরী সপ্তম সন মােতাবেক ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে দু’শ অশ্বারােহীসহ ১৬০০ মুজাহিদ নিয়ে ইহুদিদের অবস্থান কেন্দ্র খায়বারের দিকে অগ্রসর হন।

২. মুসলমানদের আক্রমণঃ খায়বার ও বনু গাতফানের মধ্যে যােগাযােগের পথ বন্ধ করে অবরােধ আরােপ করা হয়। ইহুদিদের নিকট রাসূল (স)-এর আগমনের কোনাে পূর্বাভাসই ছিল না। হঠাৎ তারা মুসলিম সৈন্যদের দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ে। রাসূল (স) প্রথমে তাদের সন্ধির প্রস্তাব করলে তারা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাই মহানবীর আদেশে মুসলমানরা প্রথম দিনেই কামুস দুর্গ ছাড়া ৫টি দুর্গ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে কামুস দুর্গে মুসলমানরা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলেও হযরত আলী (রা)-এর নেতৃত্বে এ দুর্গ হস্তগত হয়। অবশেষে তার হাতেই মারহাব নিহত হয়।

৩. বনু গাতফানের নির্লিপ্ততাঃ ইহুদিদের মিত্র বনু গাতফান গােত্র মুসলমানদের আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে ইহুদিদের সাথে মিলিত না হয়ে নির্লিপ্ত থাকে। ফলে ইহুদিরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।

৪. ইহুদিদের আত্মসমর্পণঃ দীর্ঘদিন অবরােধের পর খায়বারের ইহুদি সম্প্রদায় মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তবে রাসূল (স) তাদেরকে পূর্বের ন্যায় সকল নাগরিক সুবিধা প্রদান করেন।

খায়বার যুদ্ধের ফলাফলঃ

১. ইহুদি ষড়যন্ত্রের অবসানঃ খায়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চক্রান্তকারী ইহুদিরা ভীত হয়ে পড়ে। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের জাল বােনা চিরতরে থেমে যায়।

২. উভয়পক্ষ হতাহতের সংখ্যাঃ খায়বার যুদ্ধে ১৯ জন মুসলিম মুজাহিদ শাহাদাতবরণ করেন। ইহুদি বীর মারহাবসহ ৯৩ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয় এবং ইহুদিদের প্রচুর ধন সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র মুসলমানদের হস্তগত হয়। ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর ভাষ্যানুযায়ী, ২০ হাজারের শক্তিশালী ইহুদি বাহিনী মাত্র ১৬০০ মুজাহিদের আক্রমণে পযুদস্ত হয়ে মদিনা রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে সন্ধির প্রস্তাব জানায়।

৩. আক্রমণাত্মক অভিযানঃ খায়বার যুদ্ধ ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম আক্রমণাত্মক অভিযান। এ যুদ্ধে বিজয় ছিল প্রথম সার্থক বিজয়। আর এ যুদ্ধের ফলস্বরূপ সর্বপ্রথম আনষ্ঠানিকভাবে অমুসলিমদের যিম্মি করা হয় এবং তথায় ইসলামের শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিঃ খায়বার যুদ্ধের পর মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সচ্ছলতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। শুধু খায়বার থেকেই বাৎসরিক শস্যাদির অর্ধেক মদিনায় আসত। এ ছাড়া যুদ্ধোত্তর প্রচুর গনীমত মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনেছিল।

৫. রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ খায়বার যুদ্ধের পর মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। ইহুদিসহ অন্যদের ওপর মদিনা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। ফলে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ইহুদি সম্প্রদায় মুসলমানদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়।

৬. ফাদাক ও তায়মা দখলঃ খায়বার বিজয়ের ফলস্বরূপ উম্মুল কোরা উপত্যকার শস্য শ্যামল ফাদাক ও তায়মা অঞ্চল মুসলমানদের করতলগত হয়। ফাদাকের ভূমি মহানবী (স)-এর পরিবার পরিজনের ভরণ পােষণের জন্য নির্ধারিত হয়।

৭. রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়ঃ ঐতিহাসিক ইমামুদ্দিন বলেন, মহানবী (স) খায়বার অভিযানে যে যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন এবং পরবর্তীতে আত্মসমর্পিত ইহুদিদের ক্ষমাপ্রদর্শন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক সুবিধা প্রদানপূর্বক যে চুক্তি সম্পাদন করেন, তাতে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

৮. আসাদউল্লাহ উপাধি প্রদানঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত আলী (রা) এ যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন বলে মহানবী (স) তাকে আসাদউল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাকে বিখ্যাত জুলফিকার তরবারি প্রদান করেন।

উপসংহারঃ খায়বার বিজয় ইসলামের শাসনতান্ত্রিক কাঠামাের এক শুভ সূচনা। এ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে ইহুদি সম্প্রদায়ের দম্ভ চূর্ণ হয়। এ যুদ্ধে হযরত আলী। (রা)-এর প্রদর্শিত বীরত্ব যুগে যুগে ইসলামের মুজাহিদদের প্রেরণা যােগাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক