বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় ধর্মের অবস্থা ব্যাখ্যা কর।

ভুমিকাঃ ধর্ম একটি মৌল ও সর্বজনীন মানবীয় প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সব সমাজে সর্ববস্থায়ই ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। নৃ-বিজ্ঞানী মার্ক বলেন, 'সব সমাজই কোনাে না কোনাে পন্থায় অতিপ্রাকৃত শক্তিকে তােষামােদ করে এবং নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে।’ পৃথিবীর সব সমাজেই মানুষের জন্য, মৃত্যু, বিবাহ, মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, মৃত্যু পরবর্তী জীবন প্রভৃতিকে ঘিরে অসংখ্য আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এসব বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান থেকেই ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে।

বিভিন্ন সমাজে ধর্মের স্বরূপঃ সমাজে পরিলক্ষিত বিভিন্ন ধর্মের রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

(১) শিকার ও সংগ্রহমূলক সমাজঃ শিকার ও সংগ্রহমূলক সমাজে ধর্ম বিমূর্ত ও অতিপ্রাকৃত শক্তির ওপর বিশ্বাসনির্ভর ছিল, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ভাল-মন্দের জন্য দায়ি। এসব অতিপ্রাকৃত শক্তি সর্বত্র গাছ, পাথর, পশু, মানুষ, বায়ু, বৃষ্টি প্রভৃতির ভেতর প্রতিফলিত হতাে। যখন এসব শক্তির সাথে মানবিক গুণাবলি ও অনুভূতি যুক্ত হতাে তখনই এসব অতিপ্রাকৃত শক্তিরূপে পরিগণিত হতাে। আদিম পুরােহিতরা উর্বরতা বৃদ্ধি ও শিকারে সাফল্য লাভের জন্য যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন কলা-কৌশল ব্যবহার করতাে। সেজন্য শিকার ও সংগ্রহমূলক সমাজে সর্বশক্তিমান সত্তার কোনাে ধারণা কদাচিৎ লক্ষ্য করা যায়।

(২) উদ্যান কৃষিমূলক সত্তাঃ উদ্যান কৃষিমূলক সমাজে বৃহৎ পরিবারগুলাে জ্ঞাতিগােষ্ঠিরূপে সংগঠিত হয়। তখন অভিন্ন পূর্বপুরুষ পূজা শুরু হয়। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সমাজে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চেয়ে উক্ত সমাজে জীবিত কিংবা পরিবারপ্রধান অধিকতর শক্তিশালী বিবেচিত। এ পর্যায়েই টোটেমবাদ অন্যতম আদিম ধর্মরূপে স্বীকৃত লাভ করে। টোটেম বলতে পবিত্র গাছপালা, প্রাণি, বংশচিহ্ন ইত্যাদিকে বুঝাতাে, যেসবের মাধ্যমে জ্ঞাতি-গােষ্ঠি পরিচিতি লাভ করতাে এবং সে কারণে গােত্রগুলাের প্রতীক হিসাবে এসবকে পূজা করা হতাে। পূর্বপুরুষ পৃজা এ পর্যায়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উৎস হিসাবে গণ্য হয়। উন্নত উদ্যান কৃষিমূলক সমাজে শাসক পরিবারের প্রধান ছিল রাজা, যাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে শ্রদ্ধা করা হতাে। অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের অংশ হিসাবে বলিদান ও অন্যান্য উপহার সামগ্রি পেশাদার পুরােহিতকে দেয়া হতাে, যিনি উক্ত সমাজভুক্ত বিভিন্ন পরিবারের ধর্মীয় সেবা দান করতেন। এ ধরনের সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের মাত্রা দিয়ে বিভিন্ন পরিবারে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অসমতাকে ব্যাখ্যা করা হতাে, যাতে তারা অতিরিক্ত উৎপাদন ও ভােগে উৎসাহিত হয় এবং এর উদ্বৃত্ত শাসক পরিবারকে প্রদান করতে পারে ।

কৃষিমূলক সমাজঃ কৃষিমূলক ও পশুপালনমূলক সমাজে সর্বশক্তিমান সত্তায় বিশ্বাস অভিন্ন রূপ ধারণ করে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও নীতিবােধকে প্রভাবিত করে। এ পর্যায়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসকেন্দ্রিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটে। প্রথমে বহু দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়, যা কালক্রমে একেশ্বরবাদে পর্যবসিত হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসকেন্দ্রিক ধর্মের উৎপত্তি কৃষিমূলক উৎপাদনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কৃষিমূলক সমাজে পূর্বপুরুষ পূজার গুরুত্ব হ্রাস পায়।

(ক) সর্বজনীন ধর্মের আবির্ভাবঃ উক্ত প্রেক্ষাপটে উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং বিচিত্র সংস্কৃতির অধিকারী ও বিজিত জনগােষ্ঠির ভেতর অভিন্ন নীতিবােধ ও ধর্মীয় বাধা নিষেধ আরােপ করা আবশ্যক হওয়ায় বেশ কয়েকটি সর্বজনীন ধর্মের আবির্ভাব ঘটে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম ও বৌদ্ধ ধর্ম হলাে সর্বজনীন ধর্মের বিভিন্ন রূপ। এসব বিশ্বধর্ম সমাজের নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। বিশ্বব্যাপি এসবের বিস্তৃতি ঘটে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, সর্বজনীন ধর্মের প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের প্রাচীন হিন্দু ধর্ম, প্রাচীন চীনের কনফুসীয় ভাবাদর্শ এবং জাপানি ধর্মীয় মতবাদ অব্যাহত থাকে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, শেষােক্ত ধর্ম ও মতাদর্শে কতক সর্বজনীন ধর্মের উপাদান অন্তর্ভুক্ত হয়।

(খ) একেশ্বরবাদের ব্যাপ্তির সাথে সর্বশক্তিমান পুরুষ দেবতার যােগাযােগঃ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার যে, একেশ্বরবাদের ব্যাপ্তির সাথে সর্বশক্তিমান পুরুষ দেবতার তথা পিততন্ত্রের একটি ঘনিষ্ট যােগাযােগ রক্ষা করা যায়। তখনই পাশ্চাত্যের সমাজে নারীদের পদমার্যাদার অবনতি ঘটে। প্রাচীন ইসরাইলিদের পশুপালন সমাজে যখন একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই উক্ত সামাজিক পরিস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সাধারণত পশুপালনমলক সমাজেই সর্বশক্তিমান সত্তার আরাধনা আরম্ভ হয়। এ ধরনের সমাজে জমি ও গবাদিপশু নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সে সমাজে নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি মূল্যায়ণ করা হতাে। এ পর্যায়ে নারী-পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার পার্থক্য চরম আকার ধারণ করে। পশুপালন সমাজে নারীদের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম বলে গণ্য করা হতাে। কেননা সাধারণত মেয়েরা পশুপালনে বেশি জড়িত থাকতাে না। পুরুষরাই এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতাে।

(গ) চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাঃ এর ফলে বৃহত্তর সমাজ, ও ঘরের ভেতরে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদিতে নারী-পুরুষের পদমর্যাদা ও ভূমিকায় পার্থক্য পরিলাক্ষত হয়। উন্নত কৃষিমূলক সমাজে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতাে রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। উভয় প্রতিষ্ঠানকেই সমাজের উচ্চশ্রেণির সংগঠনরূপে গণ্য করা হয়। তখন মনে করা হতাে, রাজা ঈশ্বরের আশির্বাদের। শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেশ শাসন করছেন। এ পর্যায়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী পুরােহিতবর্গের দ্বারা ধর্মতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্ব হ্রাস পায়। খ্রিষ্টধর্মের অধীনে চার্চ সরকার থেকে বিপুল পরিমাণ করমুক্ত জমি ভােগ করতাে। যার মাধ্যমে তারা একটি ক্ষমতাশালী শ্রেণিতে পরিণত হয়। তখন শাসক ও শাসিতরা সমাজকাঠামাের পবিত্রতায় সমভাবে বিশ্বাসী ছিল।

শিল্পায়িত সমাজঃ পাশ্চাত্যে যতই শিল্পায়ন সম্প্রসারিত হয় ততই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অজ্ঞাত ও অনিয়ন্ত্রিত শক্তির ক্ষমতা বিশেষভাবে হ্রাস করে। তখন পাশ্চাত্য ধর্মে চূড়ান্ত সত্য গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। যতই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যান-ধারণার প্রসার ঘটতে থাকে ততই রহস্যাবৃত বিশ্ব উন্মােচিত হয়। এর ফলে ক্রমাগত অজ্ঞাত ও রহস্যময় সত্তার শক্তি সীমিত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়েই ধর্ম তার পূর্বের প্রভাব হারিয়ে ফেলে। তখন অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। এরই নাম ধর্মনিরপেক্ষকরণ, যা মতাদর্শগত সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র হচ্ছে এক একটি ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ। এখানে একথাও উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে পশ্চিম ইউরােপের স্পেন, ইটালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালির পরিমণ্ডলে একটি ব্যতিক্রমী চরম মতাদর্শরূপে আবির্ভূত হয়। এসব মতাদর্শ সংশ্লিষ্ট সমাজে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মকে সাংস্কৃতিক, উপ-সাংস্কৃতিক অথবা গােষ্ঠিগত প্রপঞ্চ হিসেবে আলােচনা করেছেন। তারা ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা-পদ্ধতির বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছেন। তারা ধর্মের সর্বজনীনতা এবং বিভিন্ন সমাজ ও গােষ্ঠিতে এর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করেছেন। তাই বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধর্মের রূপ ও বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন পরিলক্ষিত হয়েছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক