সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের হার্বার্ট স্পেন্সার-এর অবদান আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের হার্বার্ট স্পেন্সার-এর অবদান আলােচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানের আধুনিক তত্ত্বের বিকাশে হার্বার্ট স্পেন্সারের অবদান মূল্যায়ণ কর।

ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান বিষয়টিকে হার্বার্ট স্পেনসার ফরাসি দেশে ভিত্তি স্থাপন করেন। কারণ সেখানে সামাজিক দ্বন্দ প্রকট ছিল এবং ফরাসি বিপ্লবের পর যে সমস্যার মুখােমুখি হয়েছে তা সমাধানের কোনাে তত্ত্ব ছিল না। পরে অবশ্য তিনি ইংল্যান্ডে চলে আসেন। স্পেনসার-এর সমসাময়িককালে ইংল্যান্ডে জ্ঞানজগতের একটি প্রগতিশীল ধারা বিকাশ লাভ করেছিল। রেনেসা, পরবর্তীকালে চিন্তাচেতনা ও সমাজকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেন।

সামাজিক বিবর্তন তত্ত্বঃ স্পেনসার মনে করেন, জীবদেহ যেমন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তেমনি সমাজও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেমন প্রাণীর বিকাশ হয়, তেমনি সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজের বিকাশ হয়ে থাকে। বিবর্তন প্রক্রিয়া যেমন ব্যক্তি/প্রাণীকে সবল রাখে তেমনি বিবর্তন দ্বারা সমাজ ও প্রতিষ্ঠানসমূহও সবল থাকে।

তাত্ত্বিক অবদানঃ স্পেন্সর বহু বিষয়ে মূল্যবান অবদান রেখেছেন, এখানে কেবল তার সমাজতাত্ত্বিক রচনাবলি সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে। একথা অনস্বীকার্য যে, অনেকে স্পেন্সরের রচনাবলীর প্রতি তেমন আগ্রহ পােষণ করেন, বস্তুত স্পেন্সার বহুদিন ছিলেন অনালােচিত কিন্তু অধুনা সে অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে এবং অনেকে আবার স্পেন্সরের রচনাবলির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সমাজতত্ত্বের ইতিহাস রচনাকারীরা বলে থাকেন যে, স্পেন্সার অগাস্ট কোতের রচনা অনুসরণ করে জৈবিক এবং বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু স্পেন্সর নিজের জীবদ্দশায় কোতের প্রভাবের কথা অস্বীকার করেছেন। স্পেন্সর নিজেই কুঁতের সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎটি তােলে ধরেন।

সমাজ কাঠামাে ও শ্রেণিবিভাজনঃ সমাজের বিবর্তন সম্পর্কে স্পেন্সর তার রচনাবলিতে বিস্তৃতভাবে আলােচনা করেন। সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে তার তাত্ত্বিক অবদান স্মরণীয়। স্পেন্সর ব্যাখ্যা করেন যে, সমাজের বিকাশ হয় দু’টো ধারার মধ্যদিয়ে যেমন- (১) কখনাে আলাদাভাবে, (২) কখনও সমগ্র সমাজ একত্রে। কখনও বা তার ঘটে থাকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে আবার কখনও অন্যকতগুলি দলের সমষ্টি হওয়ার কারণ।

এভাবে যখনই অনেকগুলাে দল একত্রে জড়ীভূত হয় তখনই সমাজ কাঠামােতে জটিলতা দেখা দেয়। স্পেন্সরের মতে সমাজের প্রগতি বলতে সমাজের একত্রীভূতকরণ হয়ে থাকে কাঠামােতে বিভিন্ন শ্রেণির উদ্ভব এবং স্বতন্ত্র ক্রিয়া নির্ধারণের মাধ্যমে এবং স্পেন্সারের মতে, এ ধরনের হতে বাধ্য বিশেষ করে টিকে থাকার সংগ্রামের কারণে।

শিকার করে বেঁচে থাকার স্তরে প্রথমে এ ধরনের শ্রম বিভাজনটি দেখা যায়। একই ব্যক্তি এ সমাজে শিকারী এবং যােদ্ধা থাকে কিন্তু যে মাত্র কৃষি সমাজ হয় তখনই কৃষক এবং যােদ্ধার ভূমিকাটি স্বতন্ত্রভাবে দেখা দেয়। তেমনিভাবে উপজাতিদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে অত্যন্ত সরল কিন্তু যখনই এর রাজনৈতিক পরিধি ব্যাপক হতে থাকে, তখনই রাজনৈতিক জটিলতা এবং শ্রেণিবিভাজন বৃদ্ধি পেতে থাকে, যার প্রকাশ পায় গােত্রপ্রধান থেকে শাসক এবং সমষ্টি ইত্যাদিতে।

ধর্মের উৎপত্তিঃ স্পেন্সর বলেন, পূর্ব পুরুষের পূজা থেকে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। তিনি নৃ-বিজ্ঞানী টেইলর এর Animim কে পুরােপুরি স্বীকার বা অস্বীকার করেননি বরং গঠনমূলক সমালােচনা করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে Ancestor worshin তত্ত্ব দিয়ে নতুন ধারণার সূত্রপাত করেন। তিনি বলেছেন, প্রকৃতি পূজা পূর্ব পুরুষ পূজারই নামান্তর কেননা আদিম উপজাতিদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যে তাদের পূর্বপুরুষদের মৃত আত্ম কেউ গাছ, পাথর, পাহাড়, পর্বত, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি হয়ে গেছে। এ ধরনের বিশ্বাসের কিছু উদাহরণ বর্তমান বিশেষ সমাজ ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যেমনঃ জাপানের রাজ পরিবার সূর্য থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

জনসংখ্যা ও হার্বাট স্পেন্সরঃ মনুষ্য জগতের বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়ার সাথে মিল দেখিয়েছেন। তার মতে, মানবসমাজ যত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যায় ততই মানুষের বংশ বৃদ্ধি ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। বিবর্তনের ফলে ব্যক্তি সত্তার উন্নয়ন সাধিত হয়। তা ছাড়া বংশ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা ও ব্যক্তি সত্তার স্বকীয়তা পরস্পর বিপরীতমুখী বিষয়। তিনি বংশ বৃদ্ধি ক্ষমতার হাস প্রক্রিয়াকে Individuation বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রতিটি জীবের সমন্বিত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলােঃ (ক) যে শক্তি দ্বারা জীব আত্মরক্ষা করে, (খ) যে শক্তি দ্বারা জীব বংশবৃদ্ধি করে, (গ) যে শক্তি দ্বারা জীবন নষ্ট হয়ে যায়।

Spencer জৈবিক কার্যক্রমের তিনটি অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। যা নিম্নে ছকের মাধ্যমে দেখানাে হলােঃ


উন্নত সভ্যতার মানুষ নিজের কাজে শক্তির ব্যবহার করে থাকে। যার ফলে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে জন্মহার হ্রাস পেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। স্পেন্সার এ বিষয়ে কিছুটা অবগত ছিলেন। তার মতে, পুষ্টিকর খাদ্যের মানুষের জন্মহার বৃদ্ধি করে এবং মানুষ এটিকে ইচ্ছাধিন প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ নীতি বুর্জোয়াবাদ ও অবাধ বাণিজ্য নীতি এর একজন সমর্থক ছিলেন। স্পেন্সরের কাছে সমাজের তুলনায় ব্যক্তির স্থান ওপরে ছিল।

বস্তুনিষ্ঠ সমাজ গবেষণা ও হার্বার্ট স্পেন্সারঃ অগাস্ট কোঁৎ এবং মার্কসের মতাে স্পেন্সার সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য একটি বিজ্ঞান সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেন এবং তা সৃষ্টির পদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। তবে তারা সে বিজ্ঞান সৃষ্টিতে পদ্ধতিগত সমস্যা নিয়ে ততটা ভাবেন নি, যতটা স্পেন্সার ভেবেছিলেন। মার্কস অবশ্য সামাজিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত প্রশ্নটিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চাননি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, স্পেন্সারের কর্মসম্ভারকে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই মূল্যায়ণ করা হােক না কেন সমাজ বিকাশের ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় তার যে অবদান তা সর্বদাই অগ্রগামিতার দাবি রাখে। তাই আজও সমাজ বিজ্ঞানে তার সামাজিক বিবর্তনবাদ তত্ত্বটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক