সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থা সংক্ষেপে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থা সংক্ষেপে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সম্রাট আকবর ছিলেন একাধারে সাহসী বীর, কুশলী সমরনায়ক এবং প্রতিভাবান শাসক। তিনি স্বীয় মেধা ও প্রতিভাবলে মুঘল সাম্রাজ্যে একটি মজবুত ও শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক স্মিথের মতে, “আকবর যে সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, প্রাচ্যের নৃপতিদের মধ্যে তা অত্যন্ত বিরল এবং বিশ্বের অন্য কোনাে দেশের শাসকদের মধ্যেও সচরাচর তা পরিদৃষ্ট হয় না।”

সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থাঃ সম্রাট আকবরের শাসন ব্যবস্থাকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা ক. কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা খ, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রেণিবিভাগ গ. প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা।

ক. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাঃ সম্রাট আকবর নিজেই শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন। সম্রাটের পরেই সর্বাপেক্ষা উচ্চপদস্থ ছিলেন ওয়াকিল। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক প্রতিভাবান ব্যক্তিমাত্রই রাজকার্যে উচ্চপদে স্থান পেতেন। রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে তিনি প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে তদারক করতেন।

খ, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রেণিবিভাগঃ সম্রাট আকবর সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন। যেমন-

১. অর্থ বিভাগঃ এ বিভাগের প্রধান ছিলেন দিওয়ান। রাজকর্মচারীদের সর্বপ্রধান হিসেবে রাজস্ব বিভাগের আয় ব্যয়ের যাবতীয় কার্য তার হাতে ন্যস্ত ছিল।

২. সামরিক বিভাগঃ এ বিভাগের প্রধানকে মীর বখশী বলা হতাে। তিনি সামরিক বিভাগের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। যেমন- সেনাবাহিনীতে লোক নিয়ােগ, শৃঙ্খলা বিধান, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ, সৈন্যদের বেতন ভাতা প্রদান ইত্যাদি।

৩. বিচার বিভাগঃ বিচার বিভাগের প্রধানকে কাযীউল কু্যাত বলা হতাে। তিনি সম্রাটের অধীনস্থ সর্বোচ্চ বিচারপতি ছিলেন এবং ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

৪. পলিশ বিভাগঃ এ বিভাগের প্রধান ছিলেন কোতওয়াল। সাম্রাজ্যের আইন খালা ও শান্তি রক্ষার দায়িত্ব এ বিভাগের ওপর ন্যস্ত ছিল।

৫. সম্রাটের ব্যক্তিগত বিভাগঃ এ বিভাগের প্রধানকে খানে সামান বলা সতাে। তিনি সম্রাটের পরিবারের প্রয়ােজনীয় দ্রব্য ও খাদ্য সরবরাহের তদারকি করতেন।

৬. মুহতাসিবঃ তিনি জনসাধারণের নৈতিক কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান করতেন। বেপরােয়া মদ্যপান, জুয়াখেলা এবং শরীয়তবিরােধী কার্যকলাপ রােধ করাই ছিল তাদের দায়িত্ব।

৭. ছদরে ছুদূরঃ ধর্মীয় সম্পত্তি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারি দান বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন ছদরে ছুদূর।

৮. ডাক বিভাগঃ এ বিভাগ তথ্য আদান প্রদান করার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল।

৯. গুপ্তচর বিভাগঃ দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক খবরাখবর পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব এ বিভাগের ওপর ন্যস্ত ছিল।

১০. মুদ্রা দপ্তরঃ এ দপ্তরের প্রধানকে টাকা ও মুদ্রা প্রস্তুত কারখানার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক বলা হতাে। আবার তাকে টাকশাল দারােগাও বলা হতাে।

গ. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাঃ শাসনকার্যের সুবিধার্থে আকবর তার সাম্রাজ্যকে ১৫টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। সুবেদার বা নাযেম ছিলেন প্রদেশের শাসনকর্তা। তিনি তার কার্যাবলির জন্য সম্রাটের নিকট দায়বদ্ধ থাকতেন। সুবেদারকে তার শাসনকার্যে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন কর্মচারী নিযুক্ত থাকতেন। কর্মচারীগণ হলেন-

১. দিওয়ানঃ দিওয়ান ছিলেন প্রদেশের রাজস্ব বিভাগের প্রধান। পাশাপাশি রাজকীয় ও প্রাদেশিক ধৰ্ম সংক্রান্ত বিষয়ও তিনি তদারকি করতেন।

২. আমিলঃ আমিল ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা। এছাড়াও তিনি আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন।

৩. বিতিকিচিঃ বিতিকিচি ছিলেন স্থানীয় হিসাব রক্ষক। তিনি প্রায় আমিলের সমমর্যাদাবান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।

৪. ছদরঃ ছদর ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কর্মকর্তা। তিনি প্রদেশের বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

৫. ফৌজদারঃ জেলার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও ফৌজদার তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিদ্রোহ দমন, কর আদায়ে সহযােগিতা প্রভৃতি কার্য সম্পাদন করতেন।

৬. পােদ্দারঃ পােদ্দার ছিলেন কোষাগারের রাজকর্মচারী। কৃষকদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ এবং রাজকীয় কোষাগারে তা তালাবদ্ধ করে রাখা ছিল তার দায়িত্ব।

৭. কোতওয়ালঃ কোতওয়াল প্রদেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অপরাধীকে শাস্তিদান, অপরাধ দমন ইত্যাদি কার্যে নিয়ােজিত ছিলেন।

৮. অন্যান্য কর্মচারীঃ এছাড়াও কারকুন, কানুনগাে, মুকাদ্দাম, পাটোয়ারী প্রভৃতি কর্মচারী বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন।

উপসংহারঃ আকবরের শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত সুসংহত, সৃজনশীল ও ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐতিহাসিক বানিয়ন বলেন, “শাসক হিসেবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব ছিল বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মাবলম্বীকে একসূত্রে গ্রথিত করে একটি সুসংহত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক