অথবা, পরিবার কাকে বলে? একটি আধুনিক পরিবারের কার্যাবলি আলােচনা কর।
অথবা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের ভূমিকা ও কার্যাবলী আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সমাজের মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম মৌলিক প্রতিষ্ঠান হলাে পরিবার। পরিবার সমাজকাঠামাের মৌল অঙ্গসংগঠন। এই পরিবার মানবসৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই সমাজে বিদ্যমান। তাই এর সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক ও যােগাযােগ রয়েছে। পরিবারের সাথেই মানুষের আন্তরিক এবং অনেকটা অকৃত্রিম সামাজিক মিথস্ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। তাই পরিবার একটি সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
একটি আধুনিক পরিবারের কার্যাবলিঃ পরিবার মানবসমাজের এক গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ঐতিহ্যবাহী পরিবারের মধ্যে কোনাে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে কি না তা জানার আগে অবশ্যই পরিবারের কার্যাবলি সম্পর্কে আলােচনা করা দরকার। নিম্নে পরিবারের কার্যাবলি সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে:
(১) জৈবিক কার্যাবলিঃ জৈবিক চাহিদা মানুষের চিরন্তন। সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেন, যে মানুষ যা কিছু করে তা জৈবিক চাহিদার তাগিদেই করে থাকে। পরিবারে জৈবিক কাজ প্রধানত দুই প্রকার। যেমন- (ক) স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং (খ) সন্তান জন্মদান। মানুষ যে পরিবার গঠন করে তার প্রধান কাজ বংশ বৃদ্ধি বা সন্তান উৎপাদন করা। সমাজে অর্থনৈতিক প্রয়ােজনেও সন্তান উৎপাদন করতে হয়। সুতরাং সুস্থ সমাজ বিকাশের লক্ষ্যে জৈবিক প্রয়ােজনের বিষয়টি পরিবারের একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
(২) মনস্তাত্ত্বিক কার্যাবলিঃ সন্তান লালন-পালন পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক কাজের মধ্যে পড়ে। শিশুর গােসলদান, খাওয়ানাে, পরিচর্যা, আদর-যত্ন সর্বোপরি তাকে স্নেহের পরশে লালন-পালনের কাজটি মূলত পরিবারের। পরিবারের সদস্যরা পরিবারের মধ্যেই সহানুভূতি, ভালােবাসা, স্নেহ-মমতা পেয়ে থাকে। একে অন্যের সাথে দুঃখে সহানুভূতি দেখিয়ে থাকে। সদস্যদের কেউ কোনাে দুঃখে পড়লে অন্য সদস্য তাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে। সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত করার জন্য পরিবার বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে।
(৩) শিক্ষামূলক কার্যাবলিঃ সন্তানকে শিক্ষাদান পরিবারের একটি অন্যতম কাজ। পরিবার প্রত্যেকটি শিশুর জন্য সবচেয়ে উত্তম বিদ্যালয়। প্রত্যেকটি শিশু আপন পরিবার থেকে পারস্পরিক আচরণ, স্নেহ, প্রেম-ভালােবাস, নম্রতা, ভদ্রতা, দয়া-মায়া ইত্যাদি গুণাবলি শিখে থাকে। সুনাগরিকের গুণাবলি অর্জনে পরিবার শিক্ষা দেয়। তাই পরিবারকে নাগরিকদের প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র বলা হয়।
(৪) অর্থনৈতিক কার্যাবলিঃ উৎপাদনের একটি একক হিসেবে পরিবার অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদন করে থাকে। কৃষি সভ্যতা উদ্ভবের পর থেকে পরিবারকে নানাবিধ অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদন করতে হয়। গ্রামীণ বাংলাদেশের কৃষি পরিবারের নারী পুরুষ সবাই মিলে কৃষি কাজের বিভিন্ন দিকে অংশগ্রহণ করে।
(৫) রক্ষণাবেক্ষণমূলক কার্যাবলিঃ শিশু খুবই অসহায়। সে পরিবারের বাইরে অজানা-অচেনা মানুষকে ভয় করতে পারে। বিষাক্ত কোনাে ঔষধ সেবন করে হঠাৎ অসুস্থ হতে পারে। অন্ধকার রাতে ভয় পেতে পারে। তাই এ ধরনের বিপদ-আপদ থেকে শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
(৬) রাজনৈতিক কার্যাবলিঃ পরিবারের অন্যতম কাজ হলাে সন্তানকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তােলা। পরিবারের গণ্ডিতেই সন্তান-সন্ততি নেতৃত্ব, দায়িত্ব-কর্তব্য, নিয়ম-শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষালাভ করে। পিতামাতা ও বয়ােজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি থেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। বস্তুত পরিবার সুনাগরিক গড়ার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান।
(৭) ধর্মীয় কার্যাবলীঃ অতীতকাল থেকে মানুষ ধর্মে-কর্মে নিবেদিত ছিল। সন্তানের ধর্মীয় ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় শিক্ষা পরিবারেই প্রদান করা হয়। ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারেই লাভ করা যায়। সুতরাং ধর্মীয় কাজকর্মে পরিবার যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
(৮) সামাজিকীকরণ কার্যাবলিঃ পরিবার সন্তানদের সামাজিকীকরণ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজও করে থাকে। পরিবার সন্তান সন্ততিদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নিতে শিক্ষা দেয় এবং শিশুকে ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে তুলে।
(৯) চিত্তবিনােদনমূলক কার্যাবলিঃ মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে যেমন কাজ করতে হয়, তেমনি মনকে সতেজ করার জন্য আমােদ-প্রমােদের প্রয়ােজন হয়। এ কারণেই পরিবার ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা, ভ্রমণের ব্যবস্থা করে। সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়, পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর দেখানাের ব্যবস্থা নেয়।
(১০) সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কার্যাবলিঃ পরিবার সমাজ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম বাহন। মানবসন্তান পরিবারের মান-মর্যাদা রক্ষার্থে নিজের আচরণ সংযত এবং মার্জিত করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পরিবারের কাঠামােগত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আধুনিক পরিবার সৃষ্টি হলেও সমাজের মৌলিক ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলত পরিবারের কার্যাবলি মাধ্যমেই এর সর্বজনীনতা স্বীকৃত।
0 মন্তব্যসমূহ