অথবা, দর্শনের পরিধি বা পরিসর বা আলােচ্য বিষয় আলােচনা কর।
অথবা, দর্শনের পরিধি বা পরিসর তুলে ধর।
অথবা, দর্শনের পরিধি আলােচনা কর।
অথবা, দর্শনের আলােচ্য বিষয় বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য ও জীবনের অজস্র জটিলতা, বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়। দর্শন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দৃশ ধাতু থেকে। বাংলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ হলাে দেখা। দৈনন্দিন জীবনে দেখা বলতে আমরা চাক্ষুস প্রত্যক্ষণকে বুঝি। কিন্তু এখানে দেখা মানে চাক্ষুষ দেখা নয়। দর্শন হচ্ছে জীব ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি।
দর্শনের পরিধি/বিষয়বস্তু/আলােচ্য বিষয়ঃ কোনাে বিষয়ের আলােচ্য বিষয়ই হলাে সেই বিষয়ের পরিধি বা বিষয়বস্তু। কাজেই দর্শন যে সকল সমস্যা বা বিষয় নিয়ে আলােচনা করে তা-ই দর্শনের বিষয়বস্তু বা পরিধি ঠিক করে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে, দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়। জীবন ও জগতের প্রতিটি মৌলিক দিকই দর্শনের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এদিক থেকে দর্শনের পরিধিকে খুব ব্যাপক বলা হয়। আলােচনার সুবিধার্থে আমরা দর্শনের বিষয়বস্তুকে চার ভাগে ভাগ করতে পারি। এগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে:
১। জ্ঞানবিদ্যাঃ দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলাে জ্ঞানবিদ্যা বা জ্ঞানতত্ত্ব। দর্শনের যে বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি জ্ঞানের স্বরূপ, উৎপত্তি, বিষয়বস্তু, সীমা, যথার্থতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলােচনা করে তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা। দর্শনের কাজ হলাে জগৎ, জীবন, ঈশ্বর প্রভৃতির স্বরূপ সম্পর্কে ব্যাপক আলােচনা। কিন্তু এই আলােচনা করার আগে দার্শনিককে এসবের জ্ঞান লাভের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বিচার করে দেখতে হবে। জ্ঞানের উৎস কী? জ্ঞান লাভের উপায় কী? কতটুকু জ্ঞান লাভ সম্ভব? জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয়? যথার্থ জ্ঞানের শর্ত কী কী? জ্ঞানের সীমা কতদূর? এছাড়াও জ্ঞানের সভ্যতা ও মিথ্যাত্বের বিষয়টিও জ্ঞানবিদ্যা আলোচনা করে থাকে।
২। অধিবিদ্যাঃ দর্শনের যে শাখাটি বস্তুর প্রতিভাসিক রূপের অন্তরালে অবস্থিত প্রকৃত রূপ নিয়ে আলােচনা করে তাকেই বলে অধিবিদ্যা। অধিবিদ্যার চারটি শাখা রয়েছে। এগুলাে হলােঃ
(ক) প্রকৃতিসম্পর্কিত অধিবিদ্যাঃ অধিবিদ্যার এ শাখায় জড়, দেশ, কাল, কার্যকলাপ তত্ত্ব, দ্রব্য, জীবন, . সৃষ্টির ক্রমবিকাশ, আকার, উপাদান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে আলােচনা করা হয়।
(খ) মনসম্পর্কিত অধিবিদ্যাঃ অধিবিদ্যার এ শাখায় মন, মনের স্বরূপ, মনের সাথে দেহের সম্পর্ক, ইচ্ছার স্বাধীনতা, মন দেহের ওপর ক্রিয়া করে না দেহ মনের ওপর ক্রিয়া করে, মন কি কোনাে উপাদান দ্বারা গঠিত প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক আলােচনা করা হয়।
(গ) ঈশ্বর সম্পর্কিত অধিবিদ্যাঃ অধিবিদ্যার এ শাখায় ঈশ্বর, ঈশ্বরের স্বরূপ, ঈশ্বর আছে কি নেই, ঈশ্বরের সাথে জগতের সম্পর্ক কী, ঈশ্বর এক না বহু এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে এখানে আলােচনা করা হয়।
(ঘ) সত্তাসম্পর্কিত অধিবিদ্যাঃ সত্তা কি, সত্তাসম্পর্কিত একত্ববাদ, বহুত্ববাদ, দ্বৈতবাদ, পরম সত্তার স্বরূপ কি প্রভৃতি প্রশ্ন সত্তা সম্পর্কিত বিষয়াদি অধিবিদ্যায় আলােচনা করা হয়ে থাকে।
কাজেই আমরা দেখতে পাই যে, দর্শনের অধিকাংশ আলােচনাই এ অধিবিদ্যাতে হয়ে থাকে। এজন্য এক কথায় দর্শন মানেই অধিবিদ্যার আলােচনা বলা যায়।
৩। মূল্যবিদ্যা বা আদর্শবিদ্যাঃ দর্শনের যে শাখাটি আদর্শ ও আদর্শের স্বরূপ নিয়ে আলােচনা করে তাকে
আদর্শ বিদ্যা বলে। বিভিন্ন আদর্শের স্বরূপ, তাৎপর্য, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল প্রভৃতি পরমাদর্শের স্বরূপ উদঘাটন করাই মূল্যবিদ্যার কাজ। সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল এ তিনটি পরমাদর্শের আলােকে তাই আদর্শ বিদ্যাও তিন প্রকার। যথাঃ
(ক) যুক্তিবিদ্যা
(খ) নন্দনতত্ত্ব ও
(গ) নীতিবিদ্যা।
সত্যতার আলােচনা করে যুক্তিবিদ্যা, সুন্দরের আলােচনা করে নন্দনতত্ত্ব এবং মঙ্গলের আলােচনা করে নীতিবিদ্যা।
৪। রূপ বিজ্ঞান বা প্রকাশ বিজ্ঞানঃ বস্তু আমাদের কাছে যেভাবে উপস্থিত হয় তা হলাে বস্তুর বাহ্যরূপ। জড়, মন, প্রাণ আমাদের কাছে যেভাবে ধরা দেয় তা হলাে তাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ। বস্তুর এ পরিদৃশ্যমান বা বাহ্যরূপ নিয়ে যে বিদ্যা আলােচনা করে তাকে বলা হয় রূপবিদ্যা বা প্রকাশবিদ্যা।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শনের আলােচনার ক্ষেত্র অতি ব্যাপক। দর্শন জগৎ-জীবন, পরমসত্ত্বা ও আদর্শ বিষয়ক এক সামগ্রিক আলােচনা। কেয়ার্ড বলেন, ‘মানব অভিজ্ঞতার এমন কোনাে দিক নেই যা দর্শনের আওতায় পড়ে না বা দার্শনিক অনুসন্ধান যার দিকে প্রসারিত হয় না।'
0 মন্তব্যসমূহ