অথবা, মিরাজের রজনীতে কী ঘটেছিল?
অথবা, মিরাজের শিক্ষা আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ মহানবী (স)-এর সংগ্রামী জীবনের মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বিস্ময়কর, তাৎপর্যপূর্ণ ও অলৌকিক ঘটনা হলো পবিত্র মিরাজ। চাচা আবু তালেব ও সহধর্মিনী বিবি খাদিজা (রা)-এর মৃত্যু এবং তায়েফের নির্যাতনের পর শােকাহত নবী (স)-কে সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ তাকে স্বীয় সান্নিধ্যে টেনে নেন। ইতিহাসে এটা মিরাজ নামে পরিচিত।
মিরাজের সংজ্ঞাঃ
ক. আভিধানিক বিশ্লেষণঃ মিরাজ আরবি শব্দ, এটি উরুজ শব্দ থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ- সিঁড়ি, সােপান, ধাপ, ঊর্ধ্বগমন ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা “ইসরা” এবং রাসূলুল্লাহ (স) হাদীসে মিরাজ’ নামে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, মসজিদে আকসা থেকে মহাপ্রভুর সান্নিধ্যে সফর করাকে মিরাজ বলে।
খ. পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ ঐতিহাসিকগণ ঐকমত্য পােষণ করে বলেন, ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (স)-এর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মানব জ্ঞানের সীমানা পেরিয়ে উধ্বজগতে আরােহণ করে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যলাভ ও বাক্যালাপকে মিরাজ বলে।
অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, মহাম আল্লাহ ২৭ রজব রাতে মহানবী (স)-কে তার গৃহ থেকে বায়তুল মাকদাস হয়ে সপ্ত আসমান ভেদ করে স্বীয় আরশে আযিমে নিয়ে বেহেশত দোযখসহ সৃষ্টির রহস্যাবলি দেখিয়ে ফিরিয়ে আনেন। এ ঊর্ধ্বগমনই ইসলামী শরীয়তে মিরাজ নামে পরিচিত।
প্রেক্ষাপটঃ আপনজনদের মৃত্যুতে মুহ্যমান হয়ে পড়লে আল্লাহ তায়ালা তার হাবীবের হৃদয়ের সুপ্ত বেদনাগুলাে প্রশমিত করার জন্য নিজের একান্ত সান্নিধ্যের জন্য নবীকে ঊর্ধ্বলােকে গমন করান।
ঘটনাপ্রবাহঃ ৬২০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ রজব গভীর নিশীথে হযরত মুহাম্মদ (স) বােরাক নামক স্বর্গীয় বাহনে আরােহণ করে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় গমন করেন। সেখানে গিয়ে অযু করে সকল নবী রাসূলকে সাথে নিয়ে নিজ ইমামতিতে দু’রাকাত নামায শেষ করেন। পুনরায় বােরাকে চড়ে জিবরাঈলসহ ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন। প্রত্যেক আকাশে অবস্থানরত পয়গম্বরগণের সাথে সাক্ষাৎ শেষে সিদরাতুল মুনতাহায় গয়ে পৌছেন। সেখান থেকে রফরফ নামক অপর এক বাহন এসে নবী (স)-কে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন। অতঃপর উভয়ের মধ্যে কুশল বিনিময় হলাে।
মিরাজের প্রমাণঃ মহান আল্লাহ তায়ালা মিরাজের প্রমাণ সাপেক্ষে ইরশাদ করেন-
سبحن الذي أسرى بعبده ليؤمن المسجد الحرام الى المسجد الاقدسى الذى با كنا حوله لريه بين ايلينا طائه هو السميع البصير.
অর্থাৎ, পবিত্র সেই সত্তা যিনি রাতের কোনো এক অংশে মুহাম্মাদ (স)-কে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন। যার চারদিকে আমি পযাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি শ্রবণকারী ও দর্শনকারী।
মিরাজের তাৎপর্যঃ
১. ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞানঃ Islaim is the complete code of life. তাই ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার সব উপদেশ নির্দেশ অহীর মাধ্যমে জানানাের পরও আল্লাহ তার সান্নিধ্যে নিয়ে তার হাবীবকে আরও কিছু বিশেষ কথা বলার প্রয়ােজনে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান দান করাই মিরাজের মৌলিক লক্ষ্য।
২. বিধি-বিধান লাভঃ ঐতিহাসিক আল্লামা যুহরী ও শিবলী নােমানী বলেন, মিরাজের মাধ্যমে মহানবী (স) ইসলামী আন্দোলনের ১৪ দফা বিধি বিধান লাভ করেন।
৩. দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশলাভঃ মিরাজে গমন করে মহানবী (স) সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ৫০ ওয়াক্ত নামাযের পরিবর্তে মানব জাতির জন্য ৫ ওয়াক্ত নামায আদায়ের নির্দেশ নিয়ে আসেন। তিনি বলেন-
المملو معراج المؤمنين
অর্থাৎ, নামায মুসলমানদের জন্য মিরাজ স্বরূপ।
৪. জান্নাত জাহান্নাম দর্শনঃ এ রজনীতেই মহানবী স) জান্নাতবাণীদের অপরিসীম সুখ-শান্তি দর্শনে আনন্দিত এবং জাহান্নামবাসীদের করুণ দুঃখ ভারাক্রান্ত অবস্থা অবলােকনে দুঃখিত হন।
৫. মহানবীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিতঃ ঐতিহাসিক মুর বলেন, মহানবী (স) বিভিন্ন আসমানে তার পূর্ববর্তী অনেক নবীর সাথে দেখা করেন এবং তাদের সাথে প্রত্যক্ষ কথােপকথন করেন। এ সময় তিনি সকল নবীর ইমাম হয়ে নামায আদায় করেন। এতে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
৬. অলৌকিক দৃশ্যাবলি অবলােকনঃ ঐতিহাসিক ওয়াট বলেন, আশ্চর্য সিড়ির সাহায্যে মহানবী (স) প্রথম আসমানসহ অবশিষ্ট আকাশসমূহ ভ্রমণ করেন। এ ভ্রমণে তিনি ফেরেশতা জিবরাঈলের ৬০০ ডানা, দিগন্ত বেষ্টিত সবুজ রংয়ের রফরফ এবং বায়তুল মামুর দেখেন, যেখানে ৭০,০০০ ফেরেশতা দৈনিক তাওয়াফ করেন। আরাে অন্যান্য অনেক ভালৌকিক দৃশ্যও অবলােকন করেন।
৭. মাতাপিতার প্রতি সদ্ব্যবহারঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, মিরাজের মাধ্যমেই মহানবী (স) জানতে পারলেন, তােমরা পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাই তিনি ঘােষণা করেন- “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।”
৮. দাসদের প্রতি সদ্ব্যবহারঃ মিরাজের মাধ্যমে মহানবী (স) জানতে পারেন, তােমরা তােমাদের দাসদাসীদের সাথে ভালাে ব্যবহার করবে এবং তােমরা যা খাবে তাদেরও তাই খাওয়াবে।
৯. অন্যান্য নীতিমালাঃ এক আল্লাহর ইবাদত করা, নিকট আত্মীয়, পাড়া-পড়শী, মিসকিন, বিপদগ্রস্ত পথিক প্রভৃতির প্রতি কর্তব্য আদায় করা, অহংকার আত্মম্ভরিতা বর্জন করা, খাদ্য ও পােশাক দানের ভয়ে সন্তানদের হত্যা না করা, ব্যভিচার ও কুৎসা রটনা না করা, অজ্ঞাত বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ না করা ইত্যাদি বিষয়গুলােও মিরাজে লাভ করা নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত।
মিরাজের শিক্ষাঃ মিরাজ আমাদের সঠিক লক্ষ্য ও গন্তব্য পথের সন্ধান দেয়। আমাদের অসীম অনন্তের পথে উধাও হতে হবে এবং অজানাকে জানতে হবে, মিরাজ থেকে আমরা এ শিক্ষাই পেয়ে থাকি। মিরাজ ব্যক্তি চরিত্র ও মানবিক গুণাবলির যথাযথ উন্নয়ন সাধন করে এবং আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক খাটি করে দেয়।
উপসংহারঃ মিরাজ ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক বিস্ময়কর ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে অদ্য পর্যন্ত এরূপ অভিনব ঘটনা আর দ্বিতীয়টি কখনাে ঘটেনি। মিরাজের মাধ্যমে মানব জাতির হেদায়াতের জন্য এক অপূর্ব বৈপ্লবিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছিল।
0 মন্তব্যসমূহ