অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাস অবলম্বনে কিশাের চরিত্রের পরিচয় দাও


প্রশ্নঃ
‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাস অবলম্বনে কিশাের চরিত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে কিশাের চঞ্চল, রােমান্টিক ও ভাবুক প্রকৃতির। তার ভাবনা মূলত বাস্তবতাভিত্তিক। উপন্যাসে ইচ্ছে করলেই লেখক তাকে নায়ক-চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারতেন; কিন্তু লেখক শেষ পর্যন্ত তা করেননি।

কিশাের ও সুবল বাল্য বন্ধু, দু'জনের স্বভাব চরিত্রের প্রকৃতি ভিন্ন রকম। তবু তারা শৈশব থেকে যৌবনে পাড়ি জমায় একে অপরের হাত ধরাধরি করে। শৈশবে তারা স্কুলের পড়া ফাঁকি দিয়ে কলা গাছের খােল কেটে চটি জুতা তৈরি করতাে। জুতা পায়ে দিয়ে কিশাের সুবলের কাছে ভক্তি চায়, নিজেকে বৈকুণ্ঠ চক্রবর্তী বলে দাবি করে। শৈশবের এই খেলার গণ্ডি পেরিয়ে তারা সক্ষম পুরুষ হয়ে ওঠে মালাে সমাজের। নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কিশাের উত্তরের প্রবাসে মাছ ধরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। জগৎপুরের ডহরে যাওয়ার পরিকল্পনাও কিশােরের। কিশাের তিলক ও সুবলকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করে উত্তরের পথে। জলের বুক চিরে নৌকার দাড় বেয়ে তারা নৌকা টেনে নিয়ে যায় মেঘনার দিকে। সীমাহীন সুদূর জলরাশির দিকে তাকিয়ে কিশােরের মনে জেগে ওঠে এক ধরনের আনন্দ শিহরণ। নয়াকান্দার মালােদের স্বাধীনতা ও সুখের কথা মনে পড়ে কিশােরের। রােমান্টিক কিশাের স্বপ্ন দেখে একটি সুন্দর পরিবারের। কল্পনা ও বাস্তবতার ধ্যানে কিশােরের নৌকা ক্রমে এগিয়ে চলে উত্তরের দিকে। যাত্রাপথে কিশাের মালােদের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবে। কিশােরের জানা মতে নয়াকান্দা, শুকদেবপুরের মালােরা রয়েছে সুখে; সে ভাবে তাদের সুখের কারণ সম্পর্কে। এখানকার মালােরা জলে কাদায় : নিয়ত সংগ্রামে অর্জন করেছে অন্য রকম এক যােগ্যতা; তাদের ফলে তার মাছ ধরা বন্ধ হলেও অনাহারে মরবে না। তাদের অর্জিত কৃষিকাজের যােগ্যতা দিয়ে তারা বাঁচতে পারবে। এখানকার মালােদের জীবনের সঙ্গে কিশাের তুলনা করে গােকনঘাটের মালােদের জীবন ধারা। শুকদেবপুরের মালােরা ক্ষেতে ধান বােনে। তারাই নিজেদের ধান কাটবে। তাদের এই গৌরবে কিশাের নিজেও আনন্দিত। নতুন দেশে পৌঁছে নতুন পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে কিশাের আগ্রহী। তিলক বা সুবলের মধ্যে এ মনােভাব ছিল না। সে কারণেই কিশাের মুগরাচী’ ফুল পছন্দ করেছে সহজেই। নতুনের প্রতি তার এই অদম্য ভালাে লাগার জন্যই হয়তাে মুহূর্তের মধ্যে কিশাের ভুলেছে বাসন্তীকে। এবং খলায় দোল উৎসবে প্রেমে পড়েছে কিশাের নর্তকীর যা দেখে কিশােরের ওপর থেকে সুবলের আস্থা হয়েছে অন্তর্হিত। সুবল ভাবত, বাসন্তী কিশােরের হাঁড়িতে চাল দিয়ে রেখেছে। সুবলের এই ধারণা ও কিশােরের নিজের বিয়ের পাত্রী সম্পর্কিত ভাবনার মধ্যকার ব্যবধানই কিশাের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিশাের ভাবেঃ
“যারে লেংটা থাইক্যা দেখতাছি ছছাটোকালে যারে কোলে পিঠে লইছি হাসাইছি, কাদাইছি, ডি দেখাইছি, তেউরা বানাইয়া দিছি তারে কি বিয়া করণ যায়। বিয়া করণ যায় তারে, যার লগে কোনােকালে দেখা সাক্ষাৎ নাই।"
শুকদেবপুরে অবস্থান করার মধ্যে যেন কিশােরের জীবনবােধের পরিবর্তন ঘটে। এখানেই সে বিয়ে করে নতুন এক নারীকে; আবার তাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তার নববধূকে নয়া গাঙে হারিয়েছে- ডাকাতরা হরণ করেছে তার স্ত্রী ও অর্থ। কিশাের তার নববধূকে হারিয়ে হয়ে পড়েছে চিরউন্মাদ। আবার অনন্তর মায়ের সেবায় সে যখন সুস্থ হয়ে ওঠে। তখন সে আবার অন্যদের নির্যাতনের কারণে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছে।

শৈশবের দুরন্ত চরিত্রের কিশাের পরিণত বয়সে হয়ে যায় ভাবুক এবং আবেগ, উচ্ছাসভরা প্রেম বিলাসী নিত্য পরিশ্রমী একজন জেলে। সে মালাে সমাজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে আগ্রহী। গােষ্ঠীগত উন্নয়নের চিন্তা তার চরিত্রটিকে করে দেয় কোমল ও মানবিক। তবে তার নিয়তি এবং নির্মম পরিণতি পাঠকের মনকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক