অথবা, "কাদের যাক্তি নয় সমাজ প্রতিনিধি, আর্থিক সচ্ছলতাসম্পন্ন সামন্ত শ্রেণির উপভৌগিক মানসিকতার দীপ্র প্রতিভূ, যাদের প্রভাব ও সামাজিক অবস্থানের কারণে সত্য প্রকাশ হয় বাধাগ্রস্ত”- চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের আলােকে উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।
উত্তরঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) ‘চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪] উপন্যাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি কে কাদের। জ্যেষ্ঠভ্রাতা দাদাসাহেবের সঙ্গে কাদেরের বয়সগত ব্যবধান ত্রিশ বছরের। কাদেরের জন্মকালে দাদাসাহেবের ‘ওয়ালেদ বয়ােবৃদ্ধ'। শেষ-বয়সের সন্তান কাদেরের প্রতি তাই তার পিতার মাত্রারিক্ত স্নেহ ও প্রশ্রয় ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সমান্তরালভাবে কাদেরের স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত বিকাশ ঘটেনি। সে তার অদম্য’ খেয়ালি ভাব, উগ্র মেজাজ এবং সৃষ্টিছাড়া দুরন্তপনা'-সহই বেড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে কাদেরের এই অন্তর্গত স্বভাব প্রশমিত ও সংযত হয়নি। বিদ্যালয়ে গেলেও স্কুলের শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতির প্রতি অনিষ্ঠ ও বীতশ্রদ্ধ কাদের কেবলই পরিজনদের কাছে ‘বিদ্রোহী ছেলে’ বলে পরিচিত হয়েছে, বিদ্যালাভ করতে পারেনি। কাদেরের আঠারাে-উনিশ বছর বয়সে দাদাসাহেব তার কর্মস্থলে নিয়ে গিয়ে কাদেরকে ‘ধর্মের ব্যাপারে শিক্ষা দানের চেষ্টা’ করেন। অতঃপর কাদেরের কিছু ‘আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়েছে’ বলে তিনি মনে করেছেন। কিন্তু বাস্তবে কাদেরের চরিত্র ও চেতনাগত কোনাে পরিবর্তন ঘটেনি।
অলস নিষ্কর্মা ও লম্পট কাদের বড়বাড়ির সদস্য হওয়ার সুযােগ নিয়ে নিজের চারিপাশে আভিজাত্যময় ও অলৌকিক একটি দুর্গ তৈরি করেছে। এই দুর্গের আড়ালে তার প্রকৃত স্বরূপকে সে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। কাদের একটি রহস্যময় চরিত্র এ-উপন্যাসে। জেগে থেকেও কাদের ঘুমিয়ে, ঘুমিয়ে সে জেগে। তার রাতে সূর্য অস্ত যায় না, আবার প্রখর সূর্যলােকে রাতের অবসান হয় না। লেখক আরাে জানাচ্ছেনঃ
“আজ কাদের সম্পূর্ণভাবে নিষ্কর্মা। অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং অসামাজিক বলে তার মনের পরিচয় পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু তার বাইরের চেহারা স্বভাবত দ্ৰিালস। ম্রিালস ভাব কাটলে চরম উদাসীনতা নামে তার মুখে।"
কাদের মিঞার সন্দেহযুক্ত ও উদ্দেশ্যহীন চাল-চলনের কোনাে সদুত্তর না পেয়ে তার বড় ভাই দাদাসাহেব আলফাজউদ্দীন তাকে দরবেশ আখ্যা দিয়েছে। অতঃপর বিবাহ-বিরােধী কাদের একদা বিয়ে করেছে। কিন্তু কখনাে স্ত্রীর সঙ্গে তার সদ্ভাব হয়নি। নিস্কর্মা, অসামাজিক ও স্বল্পভাষী কাদেরের ‘দরবেশ’ খ্যাতিও দাদাসাহেবেরই দান। তার এরূপ বিশ্বাসের মূলে আছে কাদেরের নৈশ বিহার, ‘এক রাতে দরজার খিল খুলে’ বহির্গত হয়ে ‘পরদিন সকালে' রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখে তার গৃহপ্রত্যাবর্তন। কিন্তু বাস্তবে কাদের দরবেশ নয়, ইন্দ্রিয় শাসিত, ব্যক্তিগত ভােগবাদ-পরিচালিত, মাঝির বউয়ের হত্যাকারী। অন্যকে খুন করেও সে থাকে নিচুপ-নিরুত্তাপ, আত্মকৃত অপরাধের জন্য তার কোনাে অনুশােচনা নেই।
গ্রন্থের প্রথম দিকে কাদেরের চরিত্র অস্পষ্ট ও রহস্যময় বলে মনে হলেও সে যে তথাকথিত দরবেশী লেবাসের আড়ালে একজন নরপশু সেটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে সর্বাবস্থায় অনুতাপশূন্য, সবকিছু ভােগ করেও নির্বিকার, মমতাহীন ও নিষ্ঠুর। কাদের তাই ব্যক্তি নয় সমাজ প্রতিনিধি, আর্থিক সচ্ছলতাসম্পন্ন সামন্ত শ্রেণির উপভৌগিক মানসকিতার দীপ্র প্রতিভূ, যাদের প্রভাব ও সামাজিক অবস্থানের কারণে সত্য প্রকাশ হয় বাধাগ্রস্ত, আর নিমজ্জিত অস্তিত্বের মানুষ হয় আরাে নিমজ্জিত ও বিপন্ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ইচ্ছার যুগে নিহত ও নিরুদ্দেশ। সে আরেফকে সত্যকথা বলা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে; অবশ্যই সে তার নিজের অগােচণের হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে অসহায়ের মতাে বলেছে:
“কিন্তু দুর্ঘনাটির কথা কাউকে বললে আমার কি হবে জানেন?-’ফাঁসি'- তাতে আপনার লাভ কি হবে?”
তাছাড়া সত্য প্রকাশের দায়িত্বভার আরেফ আলীকে এমনই প্রবল করে তােলে যে, কোনাে ভয় কিংবা পরিণামভীতি আরেফ আলীকে তার কর্তব্য থেকে বিরত করতে পারেনি। যুবক শিক্ষক এতদিন দাদাসাহেবকে যা বলতে পারেনি সেই নির্মম, অপ্রিয় অথচ অনিবার্য সত্যই দ্বিধাহীনভাবে ও প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে পনেরাে পরিচ্ছেদে এবং যার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছেন কাদেরের হত্যাকারী চরিত্রঃ “কাদের মিঞা একটি মেয়েলােককে খুন করেছে।”
সাধারণ চোখে তাকে জাগতিক ব্যাপারে নির্লিপ্ত বলে মনে হলেও শেষে তার চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হয়। বিবাহিত হয়েও সে লম্পট কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সে দরিদ্র মাঝির স্ত্রীর সঙ্গে গােপন কামজ দৈহিক সম্পর্ক পন করে। পারিবারিক সুনাম ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়েই সে যুবতীটিকে হত্যা করে। কাহিনি যতই পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় ততই তাকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বলিষ্ঠ হতে দেখা যায়। হত্যাযজ্ঞের পর রহস্যময় 'তোসতারী কিংখাব'- এর কথা বলে আরেফকে সে এ্যাবসারডিটির দিকে নিয়ে গিয়ে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট হয়। উপন্যাস থেকেঃ
“অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে কাদের কিছু বলে ওঠে। যুবক শিক্ষিত তার কথাটা ঠিক ধরতে পারে না। কেবল কাদের কথা বলেছে বলে একটা স্বস্তির ভাব বােধ করে। নম্র কণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, ‘কী বললেন?’
কাদের দৃষ্টি পূর্ববৎ লণ্ঠনের ওপর নিবদ্ধ। একটু চুপ থেকে সে কেমন খনখনে গলায় বলে, ‘তােসতারী কিংখাবের’- কথা বলছিলাম।
আরেকটি বিসদৃশ জিনিসঃ খনখনে গলা। মুখের সঙ্গে মানায় না।
“তােসতারী কিংখাব?”
“শােনেন নাই?”
গলা আরাে নম্র করে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, “না”।
পুরােনাে আমলের জিনিস। সিন্দুকে তালা বন্ধ থাকে।
যুবক শিক্ষক বােঝে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কোনাে মূল্যবান বস্তুর কথা কাদের বলেছে, কিন্তু সে কথার আকস্মিক উত্থাপনের অর্থ সে বােঝে না।”
‘তােসতারী কিংখাব’--এই ভণ্ড সমাজের ক্রমবিলীয়মান অভিজাত্য ও ঐতিহ্যপ্রীতির রহস্যময় আবরণ। নির্মম হত্যাকাণ্ডের একমাত্র সাক্ষী আরেফ আলীর সঙ্গে শুধু মিথ্যা অভিনয়ে লিপ্ত হয় না, তাকে যে শাসায়, ফাঁসির ভয়ও দেখায়। সে পুরােপুরি অনুতাপহীন, নির্বিকার ও পরিণাম ভয়শূন্য। এর কারণ, সমাজে তার উচ্চ অবস্থান। আরেফকে সে সত্যকথনে নিবৃত্ত করার জন্য ভীতি প্রদর্শন করেছে। হত্যাকাণ্ডটির জন্য তার কোনাে অনুশােচনাবােধও নেই। দেখা যাচ্ছে , এই মিথ্যাশ্রয়ী সমাজে সম্পদ, প্রতিপত্তি ও ধার্মিকতার আড়ালে কাদেরের মতাে লােকেরা নিজেদের আসল চরিত্র গােপন রাখতে সদা তৎপর।
উপন্যাসের পরিণতিতে হত্যাকারী কাদেরের কোনাে শাস্তি হয় না। বরং হতাকাণ্ডের সাক্ষী আরেফ আলীই পুলিশের হাতে নিগহীত হয়। এই ঘটনার ভেতর দিয়ে সমাজের শাসক ও প্রভুত্বশীল শক্তির ক্ষমতার দাপটের কাছে কীভাবে ন্যায়, সত্য ও নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়- সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এর আগে ‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ধড়িবাজ ও ধর্ম ব্যবসায়ী মজিদের অসৎ ও বিবেকহীন জীবনের স্বরূপ উদঘাটন করেছিলেন। ‘চাঁদের অমাবস্যা'তে তিনি ভিন্নতর ভঙ্গিতে কপট জীবনের স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন দরবেশ বলে পরিচিতি ‘কাদের’ চরিত্রের মধ্যে। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও শুধু আপন কাম লালসা চরিতার্থ করার পর কাদের করিম মাঝির যুবতী স্ত্রীকে হত্যা করে। অথচ আত্মীয়-স্বজন, ধর্ম-সমাজ ও আইনের রক্ষকদের বশীভূত ও হাত করে হত্যার সমস্ত পায় চাপিয়ে দেয় হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী নিরীহ স্কুল শিক্ষক আরেফ আলীর ওপর। শাস্তির দায় এড়িয়ে সসম্মানে দরবেশ হিসেবে সে বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে। অন্তত ইঙ্গিতময় বর্ণনার মধ্য দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ স্বার্থান্বেষী মহলের এই কূটকৌশলকে প্রকাশ করেছেন এবং তার মাধ্যমে আমাদের সমাজের ধর্ম ও আইনের অক্ষমতা ও অসারতা যে কতখানি তা তুলে ধরেছেন। তবে এ উপন্যাসে আরেফ এর চেতন ও অবচেতন মনের উন্মােচন ও বিকাশে এবং তাকে মানবিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে উপন্যাসের কাঠামাের মধ্যে কাদের চরিত্রের উপস্থাপনা অত্যন্ত সহায়ক ও গুরুত্ববহ হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ