উত্তরঃ নামকরণের প্রাথমিক কথাঃ নামের মধ্য দিয়েই কোনােকিছুর সাথে আমাদের প্রাথমিক পঠিত ঘটে। শিরােনাম হলাে শনাক্তকারী প্রতীক। নামের মাধ্যমে ব্যক্তি বস্তু শিল্পকর্ম বা যেকোনাে বিষয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণও আর্টের অন্তর্ভুক্ত। উৎকৃষ্ট নামকরণ আয়নার মতাে শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিফলিত করে। একারণেই সার্থক সাহিত্যকর্মের অন্যতম শর্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ। কবি সাহিত্যিকগণ মূলভাব, অন্ত র্নিহিত তাৎপর্য, কেন্দ্রীয় চরিত্র, রূপক বা প্রতীকধর্মিতা, তাঁর জীবনদৃষ্টি প্রভৃতির আলােকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন।
“চাঁদের অমাবস্যা” উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতাঃ ‘চাঁদের অমাবস্যা' [১৯৬৪] সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর [১৯২২-১৯৭১] দ্বিতীয় উপন্যাস। আমরা উপরিউক্ত বিষয়-বৈশিষ্টা সামনে রেখে আলােচ্য উপন্যাসটির নামকরণের যথার্থতা বিচার করবাে। অতি সংক্ষিপ্ত কাহিনিসূত্র এ উপন্যাসের কোপন নদীর তীরবর্তী চাঁদপাড়া গ্রামের জনৈক যুবক শিক্ষিত আরেফ আলী শীতের এক উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল প্রকৃতির প্রয়ােজনে। প্রয়ােজন মিটিয়ে ঘরে ফিরে না গিয়ে সে চন্দ্রালােকিত রজনীর রূপরাশিতে মােহাবিষ্ট হয়। হঠাৎ ছায়া শরীরের আকর্ষণে সে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে। বাঁশঝাড়ে নিহত এক রমণীর লাশ দেখে সে ঘটনাটি আরেফ আলীর মনােলোকে আলােড়ন তােলে। প্রকৃত ব্যাপরটি ছিল আরেফ আলী গ্রামের যে বড়বাড়িতে আশ্রিত গৃহশিক্ষক সেই বড়বাড়িরই অন্যতম কর্তাপুরুষ কাদের আলী নিম্ন শ্রেণির এক রমণীকে সম্ভোগের উদ্দেশ্যে বাঁশঝাড়ে যায়; আরেফ সেই কাদেরকেই অনুসরণ করেছিল। আরেফের পদশব্দে ভয় পেয়ে কাদের রমণীটিকে গলাটিপে হত্য করে। পরদিন সকালে যখন সে ঘরে ফেরে, তার মুখ ফ্যাকাশে, রক্তহীন, কিন্তু চোখে অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি, অলৌকিক তৃপ্তি-সন্তোষ ভাব। আলাের মধ্যেও সে অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়- “উপরে চাঁদ হেলে-দোলে, হয়তাে হাসেও। নির্দয় চাঁদের চোখ মস্ত। যুবক শিক্ষক প্রাণভয়ে ছােটে।”
হত্যাকাণ্ডটি দেখার পর আরেফের স্বাভাবিক জীবনের শান্তি বিনষ্ট হয়েছে। জাগতিক কাজগুলাে প্রথামাফিক করলেও তার অন্তরে বয়ে চলে চেতনার সূক্ষ্ম স্রোত। শ্রেণিকক্ষে ভূগােল পড়াতে গিয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। অকস্মাৎ তার মনে উদয় হয়, কাদেরই প্রকৃত হত্যাকারী। কাদেরকে নিছক হত্যাকারী ভাবতেও তার কষ্ট হয়। জীবনের প্রতি জীবনের অনাদর মূল্যহীনতা এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড এসব জিজ্ঞাসা তার মনে জটিল অনুবর্তের সৃষ্টি করে। কুয়াশা ও জ্যোৎস্নাময় রাতে বাঁশঝাড়ের দৃশ্য যেন তাকে তাড়া করে ফিরছে। সে নানা প্রকার হ্যালুসিয়েশনে ভুগতে থাকে। মৃতদেহটি বহনের ব্যাপারেও তার মনে বয়ে যায় চেতনার বিশাল স্রোত। যেমন-
“একটি দৃশ্যই কেবল তার চোখে ভাসে। সে দৃশ্য থেকে তার নিস্তার নাই, তার মনে প্রাণে ও দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিভীষিকাময় ছায়া। সে বােঝে তার মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণা বিভাজ্য নয়, কারাে সাথে ভাগাভাগি করা সম্ভব নয়।”
পরদিন কাদের লাশ সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দিলে স্বপ্নের ঘােরে আরেফ আলী তার সঙ্গী হয়। অন্ধকারের দেয়াল বাস্ত ব জগতের সঙ্গে তার সংযােগ ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু আবার কাদেরের অর্থহীন একটি কথায় সে বুঝতে পারে, অবাস্তব জগতে প্রবেশ করেও বাস্তব জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ একেবারে ছিন্ন হয়নি। তার মনে হয়, “অবাস্তব জগৎ নেহাৎ স্বাভাবিক। তাতে কিছু অসাধারণত্ব নাই। দুটি যেন একই মুদ্রার এপাশ ওপাশ।” সম্ভবত, লেখক এখানে এটাই দেখাতে চান যে, আচ্ছন্ন অবস্থায় দেখা জগতের একরকম রূপ আর আচ্ছন্নতার ঘাের কেটে যাওয়া অবস্থায় দেখা জগতের রূপ আরেক রকম। এই দুই জগতের মাঝখানে আরেফ আলীর বিচরণ। তার মনের দ্বন্দ্ব এই দুই জগতকে নিয়ে তার কাছে এই দই জগতের অস্তিত্বই সমান সত্য।
চাঁদের অমাবস্যা ভিন্নধর্মী উপদানে সমৃদ্ধ। এ উপন্যাসের যে কাহিনি তা জীবনের একটি সাধারণ বৃত্তান্ত বা চিত্র আর নয়, এবং পরিস্থিতির অভিনবত্ব ব্যক্তিমানুষের চিত্তে মনােজাগতিক যে সংকট ও আলােড়ন সৃষ্টি করে তার জটিল বুননিকে ফুটিয়ে তােলাই এ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লক্ষ্য।
‘চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি যুবতী নারীর মৃত্যু এবং জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাতে, বাঁশঝাড়ের ভেতরে তার মৃতদেহ আবিষ্কার। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সফল ঔপন্যাসিকের শক্তিশালী লেখনী দিয়ে এই ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন, আরেফ আলীর জীবন-ভাষ্য রচনায়। তার চরিত্রের মানস পরিক্রমা ও বিশ্লেষণের ধারাতেই অগ্রসর হয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। তার সূত্রপাত হয়েছে তখনই যখন সে আকস্মিকভাবে একটি অভাবিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাত্রে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দর্শন তার নিরাবেগ জীবনপ্রবাহের আকস্মিক ছন্দপতন ঘটায়। আরেফ আলী ঘটনাকেন্দ্রিক জটিতায় আক্রান্ত হয় এবং তাকে অতিক্রম করতে গিয়ে তার অন্তরে দ্বন্দময় আবেগের সূচনা হয়। শুরু হয় তার আত্ম-দ্বন্দ্ব ও আত্ম জিজ্ঞাসা। মূল ঘটনাকেন্দ্রিক সেই আত্মসমীক্ষাকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আধুনিক কথাশিল্পীর দক্ষতা সহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি বস্তুত কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের সদ্য জাগ্রত বিবেকের উজ্জীবিত চেতনার স্বাক্ষর।
উপন্যাসটির শুরুতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের জীবনের মহা ঘটনাটি ঘটে গেছে। এক চন্দ্রালােকিত রজনীতে আরেফ আলী বেরিয়েছিল ঘর ছেড়ে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে অভিভূত ও কৌতূহলী আরেফ আলী জীবনে প্রথম বারের মতাে এক আশ্চর্য বিস্ময়ের সম্মুখীন হয়। বাশঝাড়ে নির্জন রাতে নিঃসঙ্গ নির্মম হত্যাকাণ্ড আর প্রবঞ্চক হত্যাকারীকে দেখে তার আপাত শান্ত জীবন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ থেকে শুরু হয় তার মানস পরিব্রাজনা। বহু দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও তরঙ্গ সংক্ষুব্ধ মানস পরিক্রমাকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রচলিত ছক বাধা কাহিনিতে ফুটিয়ে তােলেননি। বরং পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্য রীতিকে তিনি এ ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন।
‘চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসে কোপন নদীর ধারের ক্ষুদ্র চাঁদপরা গ্রামের জনৈক অর্ধ শিক্ষিত যুবক শিক্ষক আরেফের বিবেক চেতনার কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বক্তব্য ও প্রকরণের দিকে থেকে সর্বজনীন বিশ্ব প্রসারিত ও নিরীক্ষাশীল। তবু বিষয় আবহ নির্মাণে তিনি একান্তভাবে বাংলাদেশের জনজীবন মূল সম্পৃক্ত। তাই এ উপন্যাসটি বাংলাদেশের সমাজ পটভূমিতে ব্যক্তির সংকট, সংশয়, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মজাগরণের আধুনিক জীবনভাষ্য।
পুরাে উপন্যাসে আরেফ আলীর মনের দ্বন্দ্বটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। দ্বন্দ্ব বাস্তব অবাস্তবের দ্বন্দ্ব- তা উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থেকেছে। মৃতদেহটি দেখবার এবং সেটিকে লুকিয়ে ফেলার ঘটনাটি এক সময় তার কাছে মনে হয়েছে পুরােপুরি দুঃস্বপ্ন মাত্র। তা বাস্তব জগতে যেন ঘটেনি। কিন্তু ঘটনাটি যে বাস্তবতাকে তা গ্রাহ্য করতে হয়। কারণ, ঘরের কোণে দড়িতে লুঙ্গি ঝােলে। তার কোণটা একটু হেঁড়া। গতকাল লুঙ্গিটি সে ধুয়েছে। কিন্তু ছেড়া অংশটি সেলাই রবার সময় পায় নাই। দ্বিতীয় রাতে বাঁশঝাড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন লুঙ্গিটির সে দশা ঘটে।”
সুতরাং আরেফ আলী নতুন দ্বন্দ্বের মুখােমুখি হয়। হত্যাকারী কে? এ উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে একবার ভাবে, হত্যাকারী কাদের; আবার পরক্ষণেই মন অন্য যুক্তি খাড়া করে কাদেরকে আড়াল করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের সমাধান হয় তখন, যখন কাদের জানিয়ে যায় যে, সেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু আরেফ আলী তখন আর একটি নতুন প্রশ্নের মুখােমুখি হয়। এটি হত্যাকাণ্ড, না নিছক দুর্ঘটনা? সে ভেবে নেয়, মেয়েটির সঙ্গে কাদেরের হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ ভয় পেয়ে সে এ ঘটনা ঘটিয়ে বসেছে। তাই আরেফ মনে মনে কামনা করে, কাদের বলুক যে মেয়েটির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কাদের তাকে হতাশ করে এবং আরেফের এক ধরনের কল্পনার জন্য ক্রোধ প্রকাশ করে। ফলে বাস্তবতা ও অবাস্তবতার দ্বন্দ্বের মাঝখানে কাদেরের ঘাতক-চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবু আরেফের প্রশ্ন শেষ হয় না।
এবার তার মনে আত্মজিজ্ঞাসা জাগে। কেন সে নিজে কাদেরকে হত্যার দায় থেকে আড়াল করতে চেষ্টা করছে? কেন হত্যাকে দূর্ঘটনা এবং কাদেরকে প্রেমিক-পুরুষ হিসেবে ভাবতে চেয়েছে? সে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করে তার মন সুন্দরকে ভালােবাসে, সেই মনটি ভয়বহ হত্যাকাণ্ডে শঙ্কিত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। এরপরই সে ভয় পেয়েছে কাদেরকে। কারণ সে আশ্রিত, সে দুর্বল, সে মেরুদণ্ডহীন। কিন্তু অবচেতন মনেই তার প্রশ্ন জেগেছে- “নারীর উৎস কোথায়, কোথায় মৃত্যুর উৎপত্তি? তা ছাড়া, জীবন কি সত্যই মৃত্যুর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান।”
নিজের সীমাবদ্ধতা আবিষ্কার করার পর থেকেই তার মধ্যে এবার আত্মসচেতনতা জাগতে থাকে। কত পীড়নে সে পীড়িত হতে থাকে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের কঠোর বাস্তবতাকে প্রকাশ করে দেওয়ার মতাে মনােবল সে পায়। তাই ঈশ্বরের শরণাগত হয়। একাগ্রচিত্তে নামাজ পড়ে। কিন্তু যথেষ্ট শক্তি পায় না। বরং সেই সময় কাদেরের উপস্থিতিতে তার দৃষ্টির সামনে সে আরাে দুর্বল হয়ে পড়ে। মেয়েটির সম্পর্কে যে মিথ্যা ও অলৌকিক গল্প হতে থাকে সেটি লক্ষ করে। বিবেকের দংশনে পীড়িত হয়ে সে আত্ম-প্রবঞ্চনা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়। সে বুঝতে পারে, সকলেই সামাজিক ও আত্মরক্ষার খাতিরে প্রচণ্ড ও ভয়াবহ সত্যটিকে গােপন করতে চায়। উপন্যাসের ভাষায়-
“আসলে তারা মৃত, তাদের জীবনও ধার করা জীবন। জীবনের ব্যাপারে তারা এত প্রতারক বলেই তাদের মনে এত ভীতি, সত্য ঘটনাটি লুকাবার জন্যে এত অধীরতা, এত শঠতা।”
আরেফ আলী এক সময় সমস্ত সংশয় কাটিয়ে ওঠে। সে ভাবে, যুবতী নারীর সঙ্গে কাদেরের নিন্দনীয় সম্পর্ক ও তার দ্বারা কৃত অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের ঘটনা প্রকাশ না করে সে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তাই শেষ পর্যন্ত সে সত্য প্রকাশ করে দেয়। এখানেই আরেফ আলী পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে অস্তিত্বময় হয়ে ওঠে। আপষ, ভয়, দ্বিধা- কোনাে কিছুই আর তাকে কাবু করতে পারে না। সে দায়িত্ববান, কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করায়। ফলে চাঁদের অমাবস্যা ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার কাহিনি হয়ে ওঠে। সৌন্দর্যপ্রিয়, কোমল-হৃদয়, ভীতু-স্বভাব, লাজুক ও দুর্বলচিত্র একটি তরুণ কীভাবে স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হলাে এবং নিজ ব্যক্তিসত্তা নিয়ে জগতের মুখােমুখি দাঁড়াল-আরেফ আলীর চরিত্রে সেই জীবন-সত্যই রচিত হয়েছে।
আরেফ আলী নিশ্চিত আরামের চাকরি, স্বচ্ছন্দ আশ্রয় এবং জীবনের নিশ্চয়তা সব কিছু পরিত্যাগ করে সত্য প্রকাশের জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছে। সে আগেই ভেবে রেখেছিল, হয়তাে তার কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করলেও গ্রহণ করবে না, কিংবা সে চক্রান্তের স্বীকার হতে পারে, এমনকি তার ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে। তবু সে দায়িত্ব নিয়েই আসল সত্য প্রকাশ করেছে। আরেফ আলী মুখােশধারী সমাজের বাসিন্দা এবং পরান্নভােগী ও পরাশ্রয়ী হয়েও স্বাধীন ইচ্ছার পথে পা বাড়িয়েছে। অস্তিত্বের মানবিক দায়িত্ববােধ থেকে কাদেরকে নির্দোষ প্রমাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে যুবক শিক্ষক। এই উজ্জ্বল মানবিক মীমাংসায় উপনীত হতে তাকে অতিক্রম করতে হয় মানবীয় প্রান্তিক পরিস্থিতির জটিল, দ্বন্দ্বময় ও তমসাচ্ছন্ন পথযাত্রাঃ ‘এমন অন্ধকার জীবনে কখনাে বােধ করে নাই, অন্ধকার থেকে মুক্তিলাভের জন্য এমন তীব্র ব্যাকুলতাও কখনাে বােধ করে নাই। উপায় থাকলে সে বলতাে না। বাঁশঝাড়ে একটি নারী অর্থহীনভাবে জীবন দিয়েছে। তার বিশ্বাস মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়।' এই সর্বজনীন মানববােধ থেকে সে দাদাসাহেব, আদালত, পুলিশের কাছে প্রকাশ করলাে যুবতী নারীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যকাহিনী। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি সে প্রথমে দাদাসাহেবকে এবং পরে পুলিশকে জানায়। পুলিশ জেনে-শুনেই কাদেরের বদলে তাকে খুনী সাব্যস্ত করে।
সুতরাং সার্বিক বিচারে বলা যায়- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর “চাঁদের অমাবস্যা” উপন্যাসটি নামকরণের দিক থেকে শিল্পসাৰ্থকতার দাবিদার। মানুষের চির পরিচিত আলােকিত জগতের বাইরে প্রবহমাণ একটি অন্ধকার জগৎ- সে জগতের প্রকাশ সবার থেকে প্রত্যাশা করা অযথার্থ। কিন্তু আরেফ আলীর মতাে অস্তিত্ববাদী মানুষেরা সারাজীবন এই অন্ধকার জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন নিজের অপূরণীয় ক্ষতি-সাধনের মাধ্যমে। “চাঁদের অমাবস্যা” উপন্যাসে সত্য প্রকাশের প্রশ্নে যুবক শিক্ষকের অনমনীয়তা, পুলিশ-কর্মচারির ক্রোধে সঙ্কুচিত চোখ, থমথমে পরিপার্শ্ব এবং কনস্টেবলের বুটের আওয়াজ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে আলীর পরিণাম। আলােচ্য উপন্যাসে দেখা যায়- জটিল এক তমসাযাত্রা শেষে, আত্মদ্বন্দ্ব, আত্মহনন, আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আরেফ আলী শুদ্ধ-অস্তিত্বের আলােকিত মুক্ত দিগন্তে উপনীত হলাে- প্রথাগত সমাজের অমাবস্যায় সে নিমজ্জিত হলেও মনের আলােয় সে হয়ে ওঠে আলােকিত; সে আলাে মুক্তির-বিবেকের-ব্যক্তির।
0 মন্তব্যসমূহ