১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর


প্রশ্নঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।
অথবা, সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ ইংরেজদের দাসত্ব ও অত্যাচার থেকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অসন্তোষের ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ ১৮৫৭ সালের এ মহাবিপ্লবকে সিপাহী বিদ্রোহ বলে চিত্রিত করেছেন। মূলত এ সংগ্রাম ছিল একশ বছরের ইংরেজ কুশাসন ও দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক্যবদ্ধ জাতীয় প্রতিরােধের বহিঃপ্রকাশ।

সিপাহী বিপ্লবের কারণঃ
ক. পরােক্ষ কারণঃ সিপাহী বিপ্লবের পরােক্ষ কারণ সম্পর্কে রতন লাল চক্রবর্তী বলেন, “১৮৫৭ সালের বহুল আলােচিত সিপাহী কেবল ক্ষণকালের মধ্যে উর্থিত অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং শাসন শােষণের বলয়ে সৃষ্ট বিক্ষুব্ধ ঝঞার প্রলয়ঙ্করী আত্মপ্রকাশ।”

খ. রাজনৈতিক কারণঃ
১. স্বত্ব বিলােপ নীতিঃ গভর্নর লর্ড ডালহৌসীর লক্ষ্য ছিল, ছলে-বলে-কৌশলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্যের বিস্তৃতি ঘটানাে। তাই তিনি ‘স্বত্ব বিলােপ নীতি’ প্রবর্তন করে সাতারা, সম্বলপুর, কাশিনগর প্রভৃতি রাজ্য অধিকারপূর্বক তাঞ্জোর ও কর্ণাটের রাজপরিবারের ভাতা বন্ধ করে দেন। তার এসব পদক্ষেপ ভারতবর্ষে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ত্বরান্বিত করে।

২. অযােধ্যা দখলঃ নবাব ওয়াজেদ আলী ছিলেন অযােধ্যার সর্বশেষ নবাব। কোনাে বৈধ কারণ না থাকার পরও মিথ্যা অজুহাতে ডালহৌসী ১৮৫৬ সালের ১৩ জুলাই এক ঘােষণার মাধ্যমে অযােধ্যা গ্রাস করেন। ডালহৌসীর এ ঘৃণিত কর্মকাণ্ডে বিদ্রোহ ত্বরান্বিত হয়।

৩. মুঘল সম্রাটের প্রতি দুর্ব্যবহারঃ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের প্রতি ইংরেজ সরকার অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, যা ভারতবাসীকে গভীরভাবে মর্মাহত করে।

৪. ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচারঃ উপমহাদেশে ইংরেজ কর্মচারীদের জুলুম নির্যাতন ব্যাপক জনগণের মধ্যে ইংরেজ বিরােধী বিদ্বেষ বিতৃষ্ণা বাড়িয়ে তােলে, যা পরবর্তীতে মহাবিপ্লবে রূপ নেয়।

৫. দেশীয় নাগরিকদের উচ্চ রাজপদ থেকে অব্যাহতিঃ লর্ড-কর্নওয়ালিশ শাসন সংস্কার করে ভারতীয় তথা মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদ থেকে বাদ দেন, ফলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

গ. সামাজিক কারণঃ
৬. শাসিতের প্রতি অবজ্ঞাঃ ইংরেজ শাসকগােষ্ঠী সব সময় প্রতিটি ভারতবাসীকে সন্দেহের চোখে দেখত। অপরদিকে জনগণের প্রতি তাদের ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য বড়ই পীড়াদায়ক ছিল।

৭, পাশ্চাত্য প্রভাবঃ ক্রমবর্ধমান পাশ্চাত্য প্রভাব এবং ইংরেজদের বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ রক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলমানদের অনুভূতিতে চরম আঘাত হানে।

৮. উন্নয়নমূলক কাজে সন্দেহঃ শাসক এবং শাসিতের মধ্যে মাত্রাহীন ব্যবধান থাকায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্য, যেমন রেলপথ ও টেলিগ্রাফ, টেলিগ্রাম প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজ এ দেশের লােকজন সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।

৯. সামরিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতিঃ ইংরেজ সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যভিচার ও নৈতিকতাহীন কার্যকলাপ উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

ঘ. অর্থনৈতিক কারণঃ
১০. বহির্বাণিজ্যে ইংরেজ কর্তৃত্বঃ উপমহাদেশের বহির্বাণিজ্য ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ায় এ দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

১১. ধনসম্পদ ব্রিটেনে পাচারঃ ১৭৫৭-১৮৫৭ সালের মধ্যে ইংরেজ বেনিয়ারা এ দেশ থেকে শত শত মণ স্বর্ণ রৌপ্য ও বহু মূল্যবান খনিজ দ্রব্য ইংল্যান্ডে পাচার করে। ফলে এ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দেউলিয়া হয়ে পড়ে।

১২. দেশীয় শিল্পের বিলুপ্তিঃ এ দেশ ছিল কুটির শিল্পে সমৃদ্ধ, কিন্তু বিলাতী পণ্যের আমদানির ফলে দেশীয় শিল্প ক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকে।

১৩. জীবিকানির্বাহে ব্যাঘাতঃ অফিস আদালতে ইংরেজি ভাষা প্রবর্তিত হওয়ায় দেশীয় ভাষা এবং ফারসি ভাষায় শিক্ষিতদের জীবিকার্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

১৪. জমিদারি দখলঃ ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মুসলমানদের জমিদারির কর্তৃত্ব থেকে বিরত রেখে সকল জমিদারি হিন্দুদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। ফলে মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

ঙ. ধর্মীয় কারণঃ
১৫. খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টাঃ ইংরেজ শাসকদের সক্রিয় মদদে খ্রিস্টান পাদ্রীরা হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে পাদ্রীরা হাটে-ঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও চিকিৎসা কেন্দ্রসমূহে খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করত। এতিমখানায় দুস্থদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হতাে। এভাবে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার ও বলপূর্বক ধর্মান্তর এ দেশবাসীর ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হানে।

১৬. ধর্মীয় প্রথায় হস্তক্ষেপঃ সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ, শিশু হত্যা প্রথা নিষিদ্ধকরণ, হিন্দু বিধবাদের পুনঃ বিবাহ আইন হিন্দুদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

১৭. ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণঃ দানশীল মুসলমানগণ বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের জন্য যে সকল ভূমি ওয়াকফ করে যান, পরবর্তীতে সেসব ভূমি ইংরেজরা দখল করে সব ইসলামী প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করে। ফলে মুসলমানরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

চ. সামরিক কারণঃ
১৮. সিপাহীদের বেতন বৈষম্যঃ এ দেশীয় সিপাহীরা মাত্র ৯ টাকা মাসিক বেতন পেলেও ইংরেজ সৈন্যরা দেশীয় সৈন্যদের তুলনায় অধিক সুযােগ সুবিধা লাভ করত। বেতন বৈষম্য সিপাহীদের কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তােলে।

১৯. ইংরেজ অফিসারদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারঃ ইংরেজ সেনা অফিসারদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার এবং পক্ষপাতিত্বমূলক নীতির ফলে এ দেশীয় সিপাহীদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

২০. দেশীয় সৈন্যদের সমুদ্র পাড়ি দিতে বাধ্যকরণঃ এ দেশীয় হিন্দু সৈন্যরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে চাকরি করতে পছন্দ করত না। ১৮৫৬ সালে লর্ড ক্যানিং আইন করে তাদের বিদেশ গমনে বাধ্য করে।

২১. ইসলামী সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপঃ ইংরেজরা এ দেশীয় মুসলিম সংস্কৃতি তথা তাহযিব তমদুনের বিলােপ সাধন করে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির আমদানি শুরু করে। ফলে মুসলমানগণ ক্ষেপে যায়।

ছ. প্রত্যক্ষ কারণঃ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণে যখন বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে, তখন সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের চর্বিযুক্ত কার্তুজ আমদানি (Gressed cartidge) বারুদের স্কুপে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কাজ করে। ১৮৫৬ সালে ইংরেজ সরকার গরু ও শূকরের চর্বিযুক্ত কার্তুজ ব্যবহারের নিমিত্ত এনফিল্ড রাইফেল নামক এক নতুন রাইফেল সেনাবাহিনীতে চালু করে। এ কার্তুজ স্বভাবতই হিন্দু ও মুসলমানের নিকট ধর্ম বিরােধিতার সূক্ষ্ম পন্থা বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে সিপাহীদের মধ্যে এক প্রচণ্ড বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ বাংলাদেশের ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে নামক জনৈক সিপাহী এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘােষণা করে।

সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফলঃ
১. স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিতঃ এ বিপ্লবের ফলে ভারত উপমহাদেশের জনগণ স্বাধীনতার চেতনায় ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত হয়।

২. বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব সৃষ্টিঃ সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ ও এ দেশীয়দের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাবের সৃষ্টি হয় এবং তাদের মাঝে মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়।

৩. চরম নির্যাতনঃ এ বিদ্রোহের ফলে নির্যাতন স্বরূপ বহু মুসলমানের প্রাণদণ্ড এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

৪. বাহাদুর শাহের নির্বাসনঃ সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ ফলাফল ছিল সর্বশেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন।

৫. কোম্পানি শাসনের অবসানঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের ফলে কোম্পানি শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং সমগ্র ভারত উপমহাদেশে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

৬. স্বত্ব বিলােপ নীতির অবসানঃ লর্ড ডালহৌসির স্বত্ব বিলােপ নীতির অবসান ঘােষণা করে দেশীয় রাজন্যবর্গের অসন্তোষ দূর করা হয়।

৭. মুসলিম পুনর্জাগরণঃ সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে পুনর্জাগরণের সূচনা হয়।

৮. প্রেরণার উৎসঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের আদলে আযাদী সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও তা ছিল এ দেশবাসীর প্রেরণার উৎস।

৯. হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টাঃ ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লবের পর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রােপণের চেষ্টা শুরু হয়।

১০. ব্রিটিশ সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধিঃ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বর্ণের মধ্যে সংকীর্ণতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে ব্যাটালিয়ন ও রেজিমেন্ট ভাগ করা হয়। ফলে ব্রিটিশ সৈন্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

১১. ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীনতার মাইলফলকঃ ১৮৫৭ সালে সিপাহী জনতার সগ্রাম আপাতত ব্যর্থ হলেও এটা ছিল ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য নিশ্চিত স্বাধীনতা অর্জনের মাইলফলক।

১২. স্যার সৈয়দ আহমদের নীতিঃ এ বিপ্লবের ব্যর্থতার পর স্যার সৈয়দ আহমদ ব্রিটিশের সাথে সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আহ্বান জানান।

উপসংহারঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হয়নি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় তারই ফলে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সােনালি সূর্য পুনর্বার উদিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক