‘সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন।' (স্মল)- উক্তিটি বিশ্লেষণ কর


প্রশ্নঃ ‘সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন' স্মলের উক্তিটি আলােচনা কর।
অথবা, ‘সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন।' (স্মল)- উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ‘সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন’ সম্পর্কিত উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সামাজিক প্রক্রিয়া সামাজিক বিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সামাজিক প্রক্রিয়া দ্বারা একদিকে যেমন সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করা যায় তেমনি অন্যদিকে সামাজিক কার্যাবলিকেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সমাজ সদা পরিবর্তিত। একটি অবস্থা থেকে সমাজ পরিবর্তিত হয়ে অন্য সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে। তা ছাড়া একটি বিশেষ সামাজিক অবস্থা থেকে অপর সামাজিক অবস্থার স্থানান্তর বুঝাতে গেলেও সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন সম্পর্কিত উক্তির ব্যাখ্যাঃ Society গ্রন্থে Robert Morrison MacIver বলেন যে, মানবগােষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের ভেতর যে প্রক্রিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক একটি বিশেষ রূপ ধারণ করে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যায় তাকে সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সমাজ পরিবর্তনশীল, তাই এর ভেতর সংহতি যেমন রয়েছে তেমনি দ্বন্দও বিদ্যমান রয়েছে। সমাজ জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হলাে সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজবিজ্ঞানী স্মল এর মতে, সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন। একাধিক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে ওঠে। তাই সমাজ পাঠে ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ককে জানতে হবে। পরিবর্তনশীলতা গতিময়তা এবং চলিষ্ণুতা সামাজিক প্রক্রিয়ার মৌলিক উপাদান।

সামাজিক প্রক্রিয়ার ধারাসমূহঃ সামাজিক প্রক্রিয়ার ধারাসমূহ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বির্তক রয়েছে। নিম্নে ছকের মাধ্যমে সামাজিক প্রক্রিয়ার ধরনগুলাে তুলে ধরা হলাে-



(১) সহযােগিতাঃ সামাজিক প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক হলাে সহযােগিতা। সহযােগিতা ব্যতিত মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব নয়। আর সম্পর্ক ব্যতিত সমাজও গড়ে ওঠতে পারে না। সহযােগিতার আবার দু'টি দিক পরিলক্ষিত হয়। যথা:

(ক) প্রত্যক্ষ সহযােগিতাঃ প্রত্যক্ষ সহযােগিতার মাধ্যম হলাে ঐসব কার্যাবলি যা মানুষ একত্রে করে বা করতে পছন্দ করে। যেমন: একত্রে খেলাধুলা করা। সমাজের কিছু কিছু কাযাবাল রয়েছে যা সম্মিলিতভাবেই সম্পাদন করতে হয়।

(খ) পরােক্ষ সহযােগিতাঃ পরােক্ষ সহযােগিতা হলাে একই লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করা। এখানেই বিখ্যাত শ্রম বিভাগ নীতিটি কার্যে প্রয়ােগ করা যায়। শিল্প ক্ষেত্রে কিংবা সরকার গঠনে যখন মানুষ পারস্পরিক সন্তুষ্টি কিংবা একই লক্ষ্য অর্জনে তাদের ব্যক্তিগত পার্থক্যকে একীভূত করে তখনই পরােক্ষ সহযােগিতার নির্দেশ সৃষ্টি হয়।

(২) প্রতিযােগিতাঃ প্রতিযােগিতা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রক্রিয়া প্রতিযােগিতা হলাে সামাজিক সংযােগবিহীন পারস্পরিক ক্রিয়া। এটি একটি দিক দিয়ে যেমন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সংক্রামককে বুঝায় অন্যদিকে এটা কিছুটা নিব্যক্তিকও বটে। প্রতিযােগিতা সর্বজনীন ও নিরবিচ্ছিন্ন মানুষের অজ্ঞাতসারে ও শান্তিপূর্ণ উপায় সুস্থ প্রতিযােগিতার বিকাশ হয়।

সমাজবিজ্ঞানী গিলিন এই সম্পর্কিত আলােচনায় বলেন, মানুষ সজ্ঞানে প্রতিযােগিতায় জড়িয়ে পড়ে না কিন্তু সর্বপ্রকার প্রতিযােগিতাই মানুষের অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হয় না। তা ছাড়া সমাজে আরাে তিন ধরনের প্রতিযােগিতা দেখা যায়। নিম্নে, ছকের মাধ্যমে দেখানাে হলাে:



দ্বন্দ্বঃ ব্যক্তি বা সমষ্টি অভ্যন্তরীণ বিরােধের আরেকটি রূপ হলাে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব। প্রতিযােগিতার স্বরূপের সাথে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত পরস্পর বিরােধী দুই ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর ভেতর এটা সংঘটিত হয়। প্রতিযােগিতার মত নিরবিচ্ছন্ন ও অবিরাম নয়। সংঘাতের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তির সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিরূপিত হয়। নিম্নে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের ধরণসমূহ ছকের মাধ্যমে দেখানাে হলাে:



আত্মীকরণঃ সামাজিক প্রক্রিয়ায় আত্মীকরণ দ্বারা বহিরাগত একটি সংখ্যালঘু বর্ণগােষ্ঠী বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে দীর্ঘদিন বসবাস ও উত্তরােত্তর গ্রহণের ঐ বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হয়ে যায়। এক সময় ধারণা করা হতাে যে, এই প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র বহিরাগত বর্ণগােষ্ঠীর মধ্যেই পরিবর্তন সূচিত হয় এবং অন্তবর্তীকালীন সময়ে সমাজে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত বিরাজ করে।

উপযােজনঃ যেসব আচরণ বা কার্যাবলি দ্বারা মানুষ তার পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাওয়ায়, ঐসব আচরণ বা কার্যাবলিকে বুঝানাের জন্য মনস্তত্ত্ববিদ Jams Mark Bald win সর্বপ্রথম উপযােজন পদটি ব্যবহার করেন। উপযােজন হলাে সামঞ্জস্য বিধান বা খাপখাওয়ানাের বিষয় যা মানুষ সামাজিক সূত্রে অর্জিত আচরণ কিংবা নতুন কোনাে আচরণ গ্রহণ করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ করে থাকে। মানুষের দ্বারাই উপযােজন সম্ভব। মানুষের সামাজিক সংগঠনের বিকাশ হয়েছে প্রধানত উপযােজনের মাধ্যমে। সমাজবিজ্ঞানি Park ও Burgess দু'টি প্রধান উপযােজনের উল্লেখ করেছেন তা নিম্নে ছকের মাধ্যমে দেখানাে হলাে:


(ক) নতুন প্রাকৃতি পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানঃ প্রথমােক্ত ধরনের উপযােজন দ্বারা প্রধানত নতুন জলবায়ু, ভূমি প্রভৃতির সাথে খাপখাওয়ানােকে বুঝানাে হয়ে থাকে।

(খ) নতুন সামাজিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানঃ দ্বিতীয় ধরনের উপযােজন দ্বারা নবতর সামাজিক রীতিনীতি, লােকাচার, সামাজিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের সাথে খাপখাওয়ানােকে বুঝায়। উপযােজন বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রূপে সম্ভবপর। উপযােজনকে সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (১) বলপূর্বক নতি স্বীকার, (২) ধর্মান্তরিতকরণ, (৩) আপস রক্ষা, (৪) মহত্তারােপ, (৫) মধ্যস্থতা ও মীমাংসা, (৬) যৌক্তিকতা, (৭) সহিষ্ণুতা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নই হলাে সমাজবিজ্ঞান। কেননা একদিকে প্রক্রিয়া দ্বারা। যেমন সাধারণভাবে মিথস্ক্রিয়ার যেকোনাে প্রকাশকে বুঝানাে হয়ে থাকে তেমনিভাবে এর দ্বারা সামাজিক কার্যাবলির রূপকেও বুঝানাে সম্ভব। এ ছাড়া সমাজের পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করতে হলে সামাজিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রয়ােজন রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক