অথবা, প্রস্তর যুগের বিভিন্ন স্তরের আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ আধুনিক সভ্য জগৎ রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক সভ্য জগতের অভ্যুদয় ঘটেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে বিভিন্ন যুগের নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন। খনন কাজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ প্রাগৈতিহাসিক কালকে কতিপয় সুনির্দিষ্ট যুগে বিভক্ত করেছেন। এগুলাে হলো- প্রাচীন প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ এবং লৌহ যুগ।
প্রাচীন প্রস্তর যুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যঃ প্রাচীন প্রস্তর যুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলাে-
(১) বাসস্থানঃ প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ কোনাে রকম আশ্রয় ছাড়াই উন্মুক্ত স্থানে বসবাস করতাে। যখন তুষার যুগ অতিবাহিত হয় তখন মানুষ গুহা ছেড়ে উন্মুক্ত স্থানে বসবাস করতে শুরু করে। এভাবে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ ধাপে ধাপে অগ্রসর হয় এবং সমতল ভুমিতে তাদের আবাস স্থল গড়ে তােলে।
(২) খাদ্যাভাসঃ প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ ছিল ফলমূল এবং শাক-সবজি ভােজী। বনজঙ্গল থেকে তারা এসব খাদ্য আহরণ করতাে। কিন্তু তুষার ও বর্ষণ যুগে বহু উদ্ভিদ ধ্বংস হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে খাদ্যের অভাব দেখা যায়। তখন থেকে মানুষ শিকারী হতে শুরু করেছে।
(৩) বস্ত্রঃ প্রাচীন প্রস্তুর যুগে মানুষের পােশাক সম্পর্কে তেমন কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এ কথা মনে। করা হয় যে, তারা পােশাক তৈরী করতে না পারলেও পশুর চামড়া পরিধান করতাে।
(৪) হাতিয়ারঃ হিংস্র পশুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং শিকারের জন্য প্রাচীন প্রস্তর যুগে হাতিয়ারের প্রচলন ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় তারা কাঠের তৈরী বর্শা দ্বারা পশু শিকার করতাে। পরবর্তীতে আগুনের ব্যবহার আয়ত্তে এলে সুচারু হাতিয়ারের ব্যবহার শুরু হয়।
মধ্য প্রস্তর যুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যঃ মধ্য প্রস্তর যুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলাে-
(১) হাতিয়ারঃ এ যুগের সংস্কৃতির একটি উল্লেখযােগ্য দিক হলো হাতিয়ারের বহুল ব্যবহার। এ যুগের হাতিয়ারের ব্যবহারের বহু নিদর্শন অদ্যবধি লক্ষ করা যায়। এ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে- এ সময়ে শিকারের জন্য সর্বপ্রথম তীর ও ধনুকের ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া এ যুগের মানুষ শিকারের জন্য পাথরের তৈরী হাতিয়ার ব্যবহার করতাে।
(২) পেশাঃ পশু ও মৎস শিকার ছিল এ যুগের মানুষের প্রধান পেশা। অতি দ্রুত গতি সম্পন্ন পশু শিকার করার সময় তারা কেবল শক্তি প্রয়ােগই করতাে না, সেই সাথে বুদ্ধি ও কৌশল প্রয়ােগ করতাে। উল্লেখ্য যে, এ সময়ে পশু পালনের সূচনা হলেও কৃষি কাজের সূচনা হয়নি।
(৩) ভাষাঃ মানুষের ভাব প্রকাশের বাহন হলাে ভাষা। এটি মানুষের শ্রেষ্ট আবিষ্কার। অনুমান করা হয় যে, মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যই ভাষার উদ্ভাবন করেছে।
নব্য প্রস্তর যুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যঃ নব্য প্রস্তর যুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলাে-
(১) হাতিয়ার তৈরীর কৌশলগত দক্ষতাঃ নব্য প্রস্তর যুগের বেশির ভাগ হাতিয়ার ছিল পাথরের তৈরী। এ সময়কার মানুষ পাথর দিয়ে পাথরকে মৃদু আঘাত করে খন্ড বিখন্ড করতাে। হাতিয়ারের মাধ্যমে এ যুগের মানুষের দক্ষতার গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল।
(২) অর্থনীতি বা কৃষির সূচনাঃ নব্য প্রস্তর যুগের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলাে খাদ্য উৎপাদন বা কষির সূচনা। মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় কৃষির আর্বিভাব একটি বৈপ্লবিক ঘটনার জন্ম দেয়।
(৩) পারিবারিক জীবনঃ পরিবার নামক সর্বজনীন সংগঠন এ যুগের অবদান। এ যুগে পিতা-মাতা ভাই-বােন, দাদা-দাদী, ফুফু, চাচা সবাই মিলে একত্রে বসবাস করতাে।
(৪) বাসস্থানঃ মানব জীবনের অতিপ্রয়ােজনীয় বিষয়গুলাের মধ্যে বাসস্থান অন্যতম। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের গৃহস্থালির প্রতি লক্ষ্য করলেই- তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের আলেখ্য উদ্ভাসিত হয়। এ যুগের মানুষের গৃহ ছিল অতি সাধারণ। তারা প্রস্তর দ্বারা তাদের বাসগৃহ নির্মাণ করতাে। মূলত এ যুগে বসবাসের জন্য বাসস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিগণিত হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রস্তর যুগই আদি মানবজাতিকে আধুনিক মানবজাতিতে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এ যুগের বৈচিত্র্যময় আবিষ্কার ও উৎকর্ষতা সভ্যতার ইতিহাসে নবদিগন্তের জন্ম দেয়। সে হিসাবে প্রস্তর যুগের মানুষের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ কারণেই প্রস্তর যুগের ইতিহাসের মাধ্যমে মানবজীবনের প্রাচীন ইতিহাসের একটা রূপরেখা প্রণীত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ