উত্তরঃ ষাটের দশকের অন্যতম বিশিষ্ট গল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭]। সে যুগটা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে নতুন রীতি কৌশল অভিযােজনার উদ্দাম প্রয়াসের যুগ। সাহিত্যে নতুন টেকনিক আনয়নে– কী ভাষায়, কী বাক্য ও শব্দ গঠনে কিংবা শৈলী ও ভঙ্গিতে, বিষয়ের সংবীক্ষণ ও উপস্থাপনায়, সর্বোপরি আত্মমগ্ন চেতনার স্বাক্ষর পরাবাস্তব প্রকাশে তৎকালীন প্রজন্মের কিছু তরুণ তাদের কৃতির সাক্ষর রাখেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই প্রতিভাবান তরুণদের একজন। বাংলাদেশের আদি ও অকৃত্রিম বিষয়গুলােই গদ্যের নতুন ধারায় ও নতুন রচনা কৌশলে উজ্জীবিত হয়ে তার লেখায় প্রাণ পায়। মানুষের অন্তর্জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, যন্ত্রণাগুলাে পরাবাস্তব ভাবকে আশ্রয় করে তার গল্পে অভিনবত্বের চক সৃষ্টি করে। আর এসব কিছুই গল্পকার ইলিয়াসের মৌলিক প্রতিভার নিদর্শন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খুব বেশিসংখ্যক উপন্যাস রচনা করেননি। তিনি দুটি মাত্র উপন্যাস লিখেছিলেন। সেগুলাে হলােঃ
১. চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬] এবং
২. খােয়াবনামা (১৯৯৬)।
তিনি একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজ, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সচেতন লেখক। অনাহার, অভাব, দারিদ্র্য ও শােষণের শিকার হয়ে যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে সে-সব অবহেলিত মানুষের জীবনাচরণ তার গল্পে ও উপন্যাসে উজ্জ্বলভাবে অঙ্কিত হয়েছে। আখতারুজ্জামানের শ্রেষ্ঠ রচনা মহাকাব্যোচিত উপন্যাস খােয়াবনামা’য় গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবন ব্যবস্থাসহ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, আসামের ভূমিকম্প, তেভাগা আন্দোলন, ১৯৪৩-এর মন্বন্তর, পাকিস্তান আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনা নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে।
চিলেকোঠার সেপাইঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে এদেশের নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন যে ব্যাপকতা নিয়ে রূপায়িত হয়ে উঠেছে তাতে একে এপিকধর্মী সাহিত্য সৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উপন্যাসটির মধ্যে উনসত্তরের বিক্ষুব্ধ সমাজ রাজনৈতিক ঘটনপ্রবাহ রূপায়িত হয়ে উঠেছে। তবে ঔপন্যাসিকের বক্তব্য বিশেষ কালপরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রাণ সঞ্চারী ভূমিকার স্বরূপ নিপুণ দক্ষতায় উন্মােচিত হয়েছে এ উপন্যাসে। সমালােচকগণ এ উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে মূলত দুটি স্রোত লক্ষ করেছেন।
এক. নগর জীবন যার জটিল ও দ্বন্দ্বময় চেতনা গড়ে উঠছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, উনলিত জনস্রোত, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ এবং স্বৈরশাসনের অনুগ্রহপুষ্ট দালাল-মহাজনের সমবায়ে। শােষক-শােষিতের সম্পর্ক নিরূপণ সূত্রেই শ্রেণি-সংঘাতের অভিজ্ঞতা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সমীকৃত হয়েছে। ঘটনার এই ধারার কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে আত্মভুক চেতনালোক থেকে গণআন্দোলনের দিকে ক্রমুঅগ্রসরমান ওসমান গনি, ভাসমান শ্রমিক গণঅভ্যুত্থানের স্বতঃস্ফুর্ত সৈনিক খিজির আলি এবং পাকিস্তানি শােষক শক্তির পদাঙ্ক অনুসারী রহমতউল্লাহ।
দুই. সামন্তচেতনা ও বুর্জোয়া ভাবাদর্শের দ্বন্দ্বময় বৈশিষ্ট্যে গঠিত গ্রামজীবন যেখানে ভূমিনির্ভর জোতদার এবং ক্ষুদে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াশ্রেণির সঙ্গে বর্গাচাষি ও বিত্তহীনের শ্রেণিদ্বন্দ্ব অনিবার্যভাবেই শ্রেণিসংঘাতে হয়। উপন্যাস কাহিনির স্রোতের দুই বিপরীত মেরুতে রয়েছে আনােয়ার চেংটু, করমালি, আলি বক্স এবং খয়বার গাজী। একটি সময়পরিধির সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের সমগ্রতা সৃষ্টির প্রয়ােজনে নগর ও গ্রামের জীবনপ্রবাহকে অখণ্ড তাৎপর্য রূপায়িত করেছেন ঔপন্যাসিক।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান গণি এক বাড়ির চিলেকোঠার ভাড়াটে বাসিন্দা। সে মধ্যবিত্তের ব্যক্তিসর্বস্ব আত্মপ্রেম ও আত্মনিগ্রহপরায়ণ চেতনার প্রতিনিধি। গণআন্দোলন তাকে চিলেকোঠার বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকে বাইরে নিয়ে আসে গণঅভ্যুত্থানের ফলে তার অবস্থানচ্যুতি ঘটে এবং সে সংগ্রামে মিছিলে রক্তপাতে বিচ্ছুরিত ঢাকার বহির্জীবনে সম্পৃক্ত হয়। খিজির একটি সংগ্রামী চরিত্র। খিজিরের আত্মত্যাগের ফলেই ওসমান সংগ্রামী জনসমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয়। ওসমানের রূপান্তরের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত বাঙালি সংগ্রামী জীবনের স্বরূপ দেখানাে হয়েছে।
এ উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের শ্রেণিসংগ্রাম ও তার পরিণতির চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। রহমতউল্লাহহ ও খয়বার গাজী চরিত্র তৎকালীন শাসকের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে। গাঁয়ের মানুষকে তারা শােষণ করে। কিন্তু নিরীহ মানুষগুলাের মধ্যে সংগ্রামী চেতনার সঞ্চার হয়। গণআন্দোলনের ফলে শােষণের অবসান ঘটে এবং শ্রেণি-সত্তার বিলুপ্তি ঘটে। দেশের মুক্তি আন্দোলন মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও সংগ্রামে রূপ নেওয়া এ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে-
“এ উপন্যাসের বিষয়কল্পনার মূলে মধ্যবিত্তের আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মরূপান্তরের স্বরূপ অন্বেষণের প্রেরণাই মুখ্য। আশির দশকের রাজনীতিপ্রবাহ, সেনাতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিনাশী কর্মধারা, মধ্যবিত্তের দোদুল্যমান প্রতিবাদ ও সংগ্রাম, রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের আদর্শগত দূরত্ব, দ্বিধাবিভক্তি প্রভৃতির বাস্তব অভিজ্ঞতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে উত্তাল সময়খণ্ডের সমাজ-অম্বেষায় উদ্বুদ্ধ করেছে।”
‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে এপিক ফর্মের চিরায়ত রূপের মধ্যেই আধুনিক জীবনের জটিল সংকটকে রূপ দিয়েছেন তিনি। নির্দিষ্ট কালখণ্ডের মানবিক অস্তিত্বের সংঘর্ষ ও সামঞ্জস্য সৃষ্টির টানাপােড়েন দক্ষতার সঙ্গে রূপায়িত হয়ে এ উপন্যাসে অনুভব করা যায় শহর-গ্রামের জীবন-স্পর্শী মানুষের সংঘাতময় অন্তঃস্পন্দন। বিচিত্রধর্মী ঘটনা, নানা-মাত্রিক চরিত্র এবং উৎকণ্ঠিত সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে বিস্ফোরণ-উন্মুখ এক আত্মসত্তার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন ঔপন্যাসিক।
সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিকের অবলােকন ওসমানের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ নির্মাণ করেছে এবং এই ঘটনাপ্রবাহ সমান্তরাল দুটি রেখায় বিন্যস্ত হয়েছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকালীন উত্তাল রাজনৈতিক শহর ঢাকা এবং শ্রেণিসংঘাতদীর্ণ গ্রামীণ জনপদের আশ্রয়ে নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের বহির্ঘটনাবৃত্ত। ওসমানের আত্মসন্ধান, আত্মরক্তক্ষরণ ও আত্ম-উজ্জীবনের অন্তঃপ্রবাহী চেতনাস্রোত গড়ে তুলেছে ‘চিলেকোঠার সেপাই'- এর মৌল জীবনার্থ। ঘটনার সমান্তরাল দুই রেখার সংকর্ষে ও সংঘর্ষে নির্মিত হয়েছে এ উপন্যাসের অখণ্ড জীবনবৃত্ত।
খােয়াবনামাঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘খােয়াবনামা'। একে ‘মহাকব্যোচিত উপন্যাস' বলে অভিহিত করা হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনি রূপ লাভ করেছে বগুড়ার কাছাকাছি কাৎলাহার বিল ও তার আশেপাশের এলাকার মানুষদের নিয়ে। পােড়াদহের মেলা কেন্দ্র করে সে এলাকার যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তার খুঁটিনাটি এ উপন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে। তমিজ এ উপন্যাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র। সে এলাকার শশাষিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে শােষক শ্রেণির মানুষগুলাের শোষণের প্রতিবাদ করে। সে শোষিত মানুষের মুক্তি কামনা করেছে। এর জন্য তেভাগা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের বিচিত্র উপকরণ এ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। ব্রিটিশ আমলের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহি বিদ্রোহ, দেশবিভাগ, ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ইত্যাদি রাজনৈতিক ঘটনা উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। ‘এই উপন্যাসটি একটি দলিল’ রাজনীতির ইতিহাস, শােষিত-শোষক শ্রেণির ইস্তেহার গ্রামীণ অর্থনীতির পূর্ণ বৃত্তান্ত। মাঝি, চাষি থেকে শুরু করে সবশ্রেণির মানুষের জীবনী প্রতিমা। কৃষক শ্রমিক সকলের জীবনের সূক্ষ্ম অনুষঙ্গগুলাের বর্ণনাতেও ইলিয়াসের অন্যনতা পাঠকের নজর কেড়ে নেয়।
উপসংহারঃ সার্বিক বিচারে বলা যায়- সংখ্যাগত দিক থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস সংখ্যা দুটি হলেও তার উপন্যাসের গুণগত মান যে কোনাে ঔপন্যাসিক থেকে পৃথক এবং শিল্পসফল। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সতর্কতার সমন্বয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশের উপন্যাসের এপিক ধারায় অন্যতম শিল্পী।
0 মন্তব্যসমূহ