রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সনাতন পদ্ধতির উপাদানসমূহ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সনাতন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলাে আলােচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সনাতন পদ্ধতির উপাদানসমূহ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্মান ও ক্ষমতার জীব। গুণ-ক্ষমতা ও যােগ্যতার প্রেক্ষিতে মানুষ বিচিত্র এবং পরস্পর নির্ভরশীল। মূলত এ কারণে মানুষ বাঞ্ছিত জীবনযাত্রার প্রত্যাশায় সমাজ গঠন করে। আর এই সমাজকে সুষ্ঠু-সামঞ্জস্যশীল উপায়ে পরিচালনার মাধ্যমে শান্তি-শৃঙখলা, ঐক্য, সংরক্ষণ ও বিকাশধারা প্রবর্তনের জন্য গঠন করা হয় রাষ্ট্র। তাই সহজ কথায় বলতে গেলে যে বিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে তা-ই রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

সনাতন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যঃ রাজনৈতিক সনাতন বা ঐতিহ্যগত বিশ্লেষণধারা ঊনবিংশ শতাব্দী অবধি প্রাধান্য বিস্তারকারী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বর্তমানে বা ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি/ পদ্ধতি হলাে আদর্শমুখী পদ্ধতি। এই পদ্ধতি আলােচনায় ভালাে-মন্দের বিচার-বিশ্লেষণ স্থান লাভ করে। নিম্নে সনাতন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করা হলােঃ

(১) রাষ্ট্রকেন্দ্রিকঃ সনাতন পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলাে রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা। সনাতনবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলােচনা ছিল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। মানুষকে রাজনৈতিক জীব হিসেবে বিবেচনা করা হতাে। প্লেটো, এ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে সনাতনবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করতেন মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিকাশ কল্যাণরাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভবপর। এ জন্য তারা তাদের আলােচনাকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আইনের আলােচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন।

(২) প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকঃ সনাতন রাজনৈতিক আলােচনা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পর্যালােচনায় পর্যবসিত হতাে। এর ফলে আলােচনা হয়ে ওঠত আইনমুখী। বিভিন্ন বিগত নথিপত্র ও সংবিধানের ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামাে ও সংগঠনকে বর্ণনা করা হতাে। সুতরাং দেখা যায় যে, প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকতা সনাতন পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

(৩) সংকীর্ণতাঃ সনাতনবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সরকার, রাষ্ট্র, সার্বভৌমিকতা এবং কর্তৃত্ব ইত্যাদির নিরিখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্বাচনের চেষ্টা করেছেন। স্বাভাবিকভবেই রাজনীতি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল সংকীর্ণ। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতি এখানে কার্যত অস্বীকার করা হয়।

(৪) মূলত স্থবিরঃ সনাতন পদ্ধতি মূলত স্থবির। সনাতন বা প্রচলিত পদ্ধতিতে বিকাশ বা পরিবর্তনের গতিশীল কারণগুলাে অবহেলিত। সার্বভৌমত্বের প্রকৃত অবস্থান এতােদিন সকলের লক্ষ্যবস্তু ছিল। রাজনৈতিক দল এবং এগুলাের উৎপত্তি সম্পর্কে সকলে উৎসাহী ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা সংগঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলাে কী কী দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ একেবারে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

(৫) মূলত প্রারম্ভিকঃ বৈদেশিক সরকার সম্পর্কিত রচনাবলির বেশির ভাগ কোনাে এক বিশেষ সরকার পদ্ধতির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা কোনাে এক সরকার পদ্ধতির বিশেষ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বহুল আলােচনা সমৃদ্ধ। জেমস ম্যারিয়ট, এ কে বােইল, Jomes Bryece, Ivor H.Johns, H.D Laski, W. Wilson এবং অন্য লেখকরা তাদের রচনাবলিতে সাধারণত একটি দেশ অথবা একটি দেশের অন্যান্য বিশেষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। এদিক থেকে এসব রচনা Monograph হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

(৬) মূল্যবোধাত্মকঃ অনুমানভিত্তিক ও সনাতন পদ্ধতির আলােচনা ছিল মূল্যবোধাত্মক ও অনুমানভিত্তিক। সনাতন রাজনৈতিক অনুসন্ধানে রাজনৈতিক দর্শন আলােচনা করা হতাে। এর তিনটি বৈশিষ্ট্য হলাে অবরােহমূলক পদ্ধতির সাহায্যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রবণতা, আদর্শগত উপাদান কী হওয়া উচিত তার উপর গুরুত্বারােপ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রকৃতি ও মানবসমাজে রাজনীতির ভূমিকা সম্পর্ক আলোচনা করা। স্বাভাবিকভাবে এই আলােচনা ছিল মূল্যবোধাতত্মক ও অনুমানভিত্তিক।

(৭) একান্তভাবে বর্ণনামূলকঃ রাজনৈতিক গতিধারার সম্যক উপলব্ধির জন্য আইনানুগ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাের বর্ণনামূলক আলােচনার প্রয়ােজন রয়েছে এবং এভাবেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে তুলনামূলক আলােচনায় প্রবেশ করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাের বর্ণনার ক্ষেত্রে কোনাে কোনাে তুলনার পরিচয় অদ্যবধি কোনাে রচনাবলিতে বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি।

(৮) একান্তভাবে অতুলনামূলকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সরকারের তুলনামূলক আলােচনার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত যেসব গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে সেগুলাের বেশির ভাগ গ্রন্থে একটি বিশেষ সরকার অথবা বিভিন্ন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাের বর্ণনা করা হয়েছে। গঠনতান্ত্রিক ভিত্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতার সংগঠন ও প্রয়ােগ পদ্ধতির বর্ণনাই এ গ্রন্থাবলির প্রতিপাদ্য বিষয়। যেমন ফ্রান্সের পার্লামেন্ট স্থগিতকরণ ক্ষমতাকে অনেক সময় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

সমালােচনাঃ সনাতন বা গতানুগতিক পদ্ধতি বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে। নিম্নে সনাতন পদ্ধতির সমালােচনাসমূহ/ সীমাবদ্ধতাসমূহ আলােচনা করা হলােঃ

(১) অসম্পূর্ণতাঃ সনাতন পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গতি প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক বিষয় যেমন, জনমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, স্বার্থগােষ্ঠী, ভোট সম্পর্কিত আচরণ প্রভৃতি এই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আসে না। সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গি অসম্পূর্ণ।

(২) বিজ্ঞানসম্মত নয়ঃ সনাতন পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবসমাজের ভেতরকার সামাজিক ও আর্থিক শক্তিকে মোটেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক এবং বর্ণনামূলক আলােচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এই আলােচনা বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হয় না।

(৩) অনুন্নত দেশসমূহ উপেক্ষিতঃ সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। এ ধরনের আলােচনায় কেবল উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহই স্থান পেয়েছে। অনুন্নত দেশগুলাের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে এক্ষেত্রে উপক্ষো করা হয়েছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সনাতন পদ্ধতিগুলাে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আর কার্যকর নয়। তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নে এগুলাের সীমাবদ্ধতা অনেক। বর্তমানে রাজনীতি অধ্যয়নে নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে; যা দিয়ে তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়ন অত্যন্ত সুবিধাজনক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক