ভারতের মুসলমানদের পুনর্জাগরণে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান মূল্যায়ন কর


প্রশ্নঃ
ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের পুনর্জাগরণে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, ভারতের মুসলমানদের নবজাগরণে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম সমাজের উন্নতিতে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এর ভূমিকা বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মুসলমানদের ওপর দমন নিপীড়নের লােমহর্ষক স্টিম রােলার চালায়। মুসলিম জাতির এ দুর্যোগক্ষণে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আগমন ঘটে।

মুসলিম পুনর্জাগরণে সৈয়দ আহমদ খানের অবদানঃ নিম্নে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান আলোচনা করা হলো-

১. ইংরেজদের দমননীতি পরিবর্তনে ভূমিকাঃ সিপাহী বিপ্লবের কারণে ইংরেজ শাসকরা মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর চরম বিরূপ মনােভাবাপন্ন হয়। ইংরেজ শাসকদের মন থেকে মুসলমানদের সম্পর্কে অমূলক সন্দেহ দূর করার উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদ খান ১৮৫৭ সালে ‘আসবাবে বাগাওয়াতে হিন্দ’ নামক একখানা পুস্তক রচনা করেন। এতে তিনি মহাবিপ্লব পূর্ব কোম্পানি শাসনের তীব্র সমালােচনা করেন এবং শাসনব্যবস্থার ত্রুটিগুলাে তুলে ধরেন।

২. পত্রিকা প্রকাশঃ মুসলিম জাগরণের অগ্রনায়ক স্যার সৈয়দ আহমদ খান ভারতের ‘রাজানুগত মুসলিম সম্প্রদায়’ নাম দিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বস্ত সেবার নীতিগুলাে বর্ণনা করেন।

৩. ইন্ডিয়ান এসােসিয়েশন গঠনঃ মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব দূরীকরণের উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদ খান ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসােসিয়েশন (British Indian Association) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এ প্রতিষ্ঠান সাফল্যজনকভাবে দেশের অভাব অভিযােগের প্রতি ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্যার সৈয়দ আহমদের এসব প্রচেষ্টার ফলে ও হান্টারের সুপারিশে মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশ দমন নীতির পরিবর্তন সূচিত হয়।

৪. ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আহ্বানঃ স্যার সৈয়দ আহমদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষা ব্যতীত মুসলমানদের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার আহ্বান জানান। এজন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্থাপন এবং ইংরেজি গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদ করার ব্যবস্থা করেন।

৫: ইংল্যান্ড গমনঃ ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন করে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তিনি ১৮৬৯ সালে ইংল্যান্ডে গমন করেন।

৬. পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণঃ আধুনিক শিক্ষার রূপকার এ প্রাণ পুরুষ ১৮৭০ সালে দেশে ফিরে তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি সমিতি গঠন করে, এর মাধ্যমে তরুণ যুবকদের মাঝে শিক্ষার আলাে সম্প্রসারণ করতে থাকেন। এমনকি এ লক্ষ্যে তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা নীতির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্য থেকে পাশ্চাত্য ভীতি দূর করার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ ও প্রকাশ করেন।

৭. আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঃ ঐতিহাসিক হান্টার বলেন, মুসলিম সমাজের উন্নয়নকল্পে তিনি ১৮৭৫ সালে আলীগড় মােহামেডান ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন। অচিরেই কলেজটি মুসলিম ভারতের জ্ঞানকেন্দ্র এবং পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।

৮. আলীগড় আন্দোলনঃ আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজের সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের যে আন্দোলন আরম্ভ করেন তা ‘আলীগড় আন্দোলন' নামে পরিচিত। ফলে পশ্চাৎপদ মুসলিম যুবকগণ ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে শাসন বিভাগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে। পরিণতিতে তারা আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পায় এবং রাজনৈতিক চেতনা লাভ করে।'

৯. আন্দোলনের মুখপত্র প্রকাশঃ আলীগড় আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে তিনি ‘তাহযীবুল আখলাক’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা বের করেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নের প্রস্তাব করা হতাে।'

১০. খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতার মােকাবেলাঃ তিনি খ্রিস্টান মিশনারী তৎপরতা মােকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার সাধন করেন। আর এ লক্ষ্যে তিনি কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জনে ব্যাপৃত হন।

১১. স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূতঃ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন অনুভব করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ঘােষণা করেন, মুসলমান ও হিন্দু দুটি স্বতন্ত্র জাতি। মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি ১৮৯৩ সালে মুসলিম রক্ষা সমিতি গঠন করেন। তার প্রচারিত ধ্যান-ধারণা থেকেই মুসলমানগণ স্বাধীন দেশের দীক্ষা গ্রহণ করে। এজন্যই ঐতিহাসিক হান্টার ন্যায়সঙ্গতভাবে তাকে মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বলে অভিহিত করেন।

১২. জাতীয় সংহতি সৃষ্টিঃ মুসলমানদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য সংহতি সৃষ্টির জন্য সৈয়দ আহমদ খান আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আলীগড়ের Gradugte-গণ তার ঐক্য স্থাপনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র দেশে তা প্রচার করে এক অভূতপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি করেন।

১৩. মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টাঃ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আলীগড়ের ছাত্ররাই তার ঐক্য স্থাপনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র দেশে এক অপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করে।

১৪, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাঃ আলীগড় আন্দোলনের সাথে জড়িত কতিপয় মুসলমানের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক হান্টার বলেন, ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা সৈয়দ আহমদ খানের শিক্ষারই ফসল।

উপসংহারঃ স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে সুচিন্তিত তাত্ত্বিক সাধনা, মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ তাকে মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম চিন্তাবিদে পরিণত করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক