মদিনার ইহুদিদের সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সম্পর্ক আলোচনা কর


প্রশ্নঃ মদিনার ইহুদিদের সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সম্পর্ক বর্ণনা কর।
অথবা, মদিনা থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার ইতিহাস বর্ণনা কর।
অথবা, মদিনার তিনটি ইহুদি গোত্রের বিতাড়ণের কারণ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, মুহাম্মদ (স) কর্তৃক ইহুদিদের নির্বাসিত করার ইতিহাস বর্ণনা কর।

উপস্থাপনাঃ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (স) মদিনায় আগমন করলে প্রথমত তথাকার ইহুদি খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকলেই তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। মদিনায় অবস্থান সময়ে মহানবী (স) ইহুদিসহ সকল ধর্মের লোকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন, কিন্তু ইহুদিরা মহানবী (স)-এর সাথে শত্রুতাবশত হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে থাকে। তাই ন্যায়ের প্রতীক রাসূল (স) তাদের অন্যায় অপকমের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

মদিনার ইহুদি গােত্রসমূহঃ রাসূল (স) যখন মদিনায় আগমন করেন তখন ইহুদিদের তিনটি উপগােত্র ছিল। উপগােত্রগুলাে হলাে- ১. বনু কাইনুকা, ২. বনু নযীর ৩. বনু কুরাইযা।

মদিনার ইহুদিদের সাথে মহানবী (স)-এর সম্পর্কঃ
১. প্রতিশ্রুত নবী হিসেবে গ্রহণঃ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে মদিনার ইহুদিরা তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের মাধ্যমে একজন বিশ্বনবীর আগমনের কথা অবগত ছিল। মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির সংবাদ পাওয়ার পর তারা তাকে প্রতিশ্রুত বিশ্বনবী Promised Prophet হিসেবে নিজেদের মধ্যে পাওয়ার জন্য মদিনায় আমন্ত্রণ জানায়।

২. বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনঃ মহানবী (স) মদিনার সকল প্রকার দ্বন্দ্ব-কলহ দূরীভূত করে তথায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল শ্রেণির ও জাতির মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে বিশেষ করে মদিনার ইহুদিদের সাথে মহানবী (স)-এর বন্ধুত্বপূর্ণ সকল শ্রেণীর ও জাতির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

৩. সমমর্যাদাভিত্তিক সনদ স্থাপনঃ মদিনার সার্বিক সমৃদ্ধি অর্জন ও বহিঃশত্রুর হাত হতে রক্ষার জন্য রাসূল (স) মদিনার সকল গােত্রসমূহকে সমান মর্যাদা প্রদান করে একটি সনদ কায়েম করেন। এ সনদ দ্বারা সকল গােত্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষিত হয়। তদুপরি এ মর্মে চুক্তি হয়, মুসলমান ও ইহুদিরা পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে অবস্থান করবে। একে অপরকে আক্রমণ করবে না, কেউ আক্রান্ত হলে পারস্পরিক সহযােগিতার ভিত্তিতে তা মােকাবেলা করা হবে।

৪. ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতাঃ ইহুদিরা যখন উপলব্ধি করতে পারল যে, মুহাম্মদ (স) ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার সার্বিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তখন তারা বেকে বসে। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা গােপনে ইসলামের মূলশত্রু কুরাইশদেরকে মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার আহ্বান জানায়। মদিনা সনদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তারা ইসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন করার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে।

৫. মহানবী (স)-এর আচরণঃ ইহুদিদের ঘৃণ্য শত্রুতা ও মারাত্মক প্ররােচনা সত্ত্বেও মহানবী (স) তাদের প্রতি যে উদারতা ও মহানুভবতা প্রদর্শন করেন, ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “মহানবীর কোনাে দয়া অথবা বদান্যতাই ইহুদিদের সন্তুষ্ট করতে পারত না।”
ন্যায় ও সত্যের মূর্ত প্রতীক মহানবী (স) ইহুদিদের ক্রমাগত শত্রুতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মদিনা থেকে বিতাড়িত করেন।

মদিনা থেকে ইহুদিদের নির্বাসন সংশ্লিষ্ট কারণ ও সময়ঃ মহানবী (স) কর্তৃক ইহুদিদের মদিনা থেকে নির্বাসিত করার সংশ্লিষ্ট কারণ ও সময় নিম্নরূপঃ

১. বনু কায়নুকা গােত্রঃ নির্বাসিত করার কারণঃ অর্থ সম্পদ ও যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শীতার জন্য বানু কায়নুকা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। বদরের যুদ্ধের সময় মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তারা মুসলমানদের গােপনীয় সংবাদাদি সরবরাহ করে সর্বপ্রথম মদিনা সনদের শর্ত লঙ্ঘন করে। তাদের নেতা কাব মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হিংসাত্মক ও বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু করে। একদিন তাদের বাজারে জনৈক আনসারী মহিলাকে অপমান করায় মুসলমানদের সাথে তাদের দাঙ্গা শুরু হয়। রাসূল (স) তা মীমাংসার উদ্যোগ নিলে তারা তা ব্যর্থ করে দেয়।

সময়কাল ও শাস্তিঃ উক্ত প্রেক্ষিতে ততীয় হিজরীতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে ইসলামের অস্তিত্ব সংরক্ষণের পথে বাধা বিদুরিত করার ব্যবস্থা স্বরূপ বাসূল (স) বনু কায়নুকা সম্প্রদায়কে মদিনা থেকে সিরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিধর্মীদের প্ররােচনা দান করার জন্য তাদের নেতা কাবকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

২. বনু নযীর গােত্রঃ 
নির্বাসনের কারণঃ উহুদের যুদ্ধে কুরাইশদেরকে উস্কানী ও সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে বনু নীর গােত্র মদিনা সনদের শর্ত ভঙ্গ করে। এমনকি আমর ইবনে জাহানের নেতৃত্বে ইহুদিরা দেয়ালের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে মহানবী (স)-কে হত্যার অপচেষ্টা চালায়।

সময়কাল ও শাস্তিঃ বনু নবীর গোত্রের অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য মহানবী (স) তাদের নেতা কাব ইবনে আশরাফ ও আবু রাফে সাল্লামকে হত্যার নির্দেশ দিলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মহানবী (স) তাদের একটি খণ্ড যুদ্ধে পরাজিত করে চতুর্থ হিজরী মােতাবেক ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে মদিনা থেকে সিরিয়ায় বহিষ্কার করেন।

৩. বনু কুরাইযা গােত্রঃ
নির্বাসনের কারণঃ মদিনার বিশ্বাসঘাতক ইহুদি গােত্রের সর্বশেষ সম্প্রদায় ছিল বন করাইযা। উহুদ যুদ্ধের সময় তারা ইসলামবিরােধিদের সাথে গােপন আঁতাত করেছিল। পরবর্তী সময়ে তারা মুসলমানদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিলে রাসুল (স) তাদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু তারা খন্দক যুদ্ধে আবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে কুরাইশদের পক্ষাবলম্বন করে। এমনকি প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘােষণা করে মুসলমানদের জীবন বিপন করে তােলে। তাদের এরূপ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে।

সময়কাল ও শাস্তিঃ খন্দকের যুদ্ধে ইহুদিদের মিত্রশক্তি পরাজয়ের পর বন কুরাইযাকে সমুচিত শাস্তি হিসেবে মদিনা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয় । কিন্তু বাসল (স) এর আদেশ অমান্য করায় তাদের দুর্গ অবরােধ এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। চােখের তাদের ইচ্ছানুযায়ী আউস গােত্রের দলপতি সাদ ইবনে মুয়াযের ওপর বিচারের ভার তাে হয়। অবশেষে ষষ্ঠ হিজরীতে বিচারক হযরত সাদ মদিনা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিরুধে চক্রান্ত ও প্রকাশ্য তৎপরতা এবং বহিঃশত্রুর মদদ দেয়ার অপরাধে তাদের যুদ্ধক্ষম ২০০ জন পুরুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড এবং অবশিষ্ট নারী ও শিশুকে দাসে পরিণত করার রায় দেন। বাকি অন্যান্যদেরকে সিরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানাে হয়।

ইহুদিদের নির্বাসনের অন্যান্য কারণঃ
১. অর্থনৈতিক তৎপরতাঃ মুসলমানদের আর্থনৈতিক সমদ্ধির কারণেও ইহুদিরা শক্রতা শুরু করে। তাছাড়া সুদী কারবার ব্যবহৃত হওয়ায় তারা মুসলমানদের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। যা পরবর্তীতে তাদের নির্বাসনে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাড়ায়।

২. অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতাঃ ইহুদিরা সুকৌশলে মদিনার দু’মুসলিম গােত্র আওস ও খাযরাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এমনকি কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের সাথে গােপনে আঁতাত করে রাসূল (স)-কে হত্যার প্রচেষ্টাসহ সব ধরনের শত্রুতাই শুরু করে। এটাও তাদের নির্বাসনের অন্যতম কারণ।

রাসূল (স)-এর ইহুদিনীতির পর্যালােচনাঃ স্প্রেঙ্গর, উইল ওসবর্ন প্রমুখ ইউরােপীয় ঐতিহাসিকগণ মহানবী (স)-এর ইহুদিনীতির বিরূপ মন্তব্য করলেও নিরপেক্ষ সমালােচনায় ঐতিহাসিকগণ বলেন, ইহুদিদের দেশদ্রোহীতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও নাশকতামূলক অপরাধের কার্যকরি শাস্তি তাদের অপরাধের তুলনায় খুবই নগণ্য। আর রাসূল (স) ইহুদিদেরকে শাস্তি প্রদান করেন রাজনৈতিক কারণে, ধর্মীয় কারণে নয়। এমনই মন্তব্য করে উইলিয়াম মূর বলেন- The ostensible ground of which Mohammad (sm) punished the Jews was political and not religious.

উপসংহারঃ মহানবী (স) মদিনার ইহুদিদের সাথে মধুর সহাবস্থান সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু দুর্মতি ইহুদিদের জঘন্য বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপের কারণে মহানবী (স) তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। সতরাং যে কোনাে দিক বিচারে রাসুল (স) এর এই সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক ও ন্যায্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক