উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান সচেতন এবং শক্তিমান শিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১)। জীবননিষ্ঠ, আধুনিক শিল্পপ্রকরণ, তীব্র শৈল্পিক সচেতনা, সংযম, দক্ষতা ও পরিমিতিবােধ তার ঔপন্যাসিক প্রতিভার মূল বৈশিষ্ট্য। জীবন, ব্যক্তি এবং পরিবেশের গ্রন্থিসমূহের উন্মােচনে তিনি ছিলেন সতত তার প্রবণ। তার রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছে পরাবাস্তববাদের দর্শন। আলােচ্য নিবন্ধে আমরা পরাবাস্তববাদ কী এবং ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।
পরাবাস্তববাদ কীঃ বাস্তবতার অতীত যে জগৎ তাই পরাবাস্তব বা surrealism। সত্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। বাস্তবতা বা Reality কে একেবারে দৃশ্যমান করে দেখানাে যায় না। তাই অনেক কিছু বুঝতে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। পরাবাস্তবতাও সে-জাতীয় কল্পনা। পরাবাস্তববাদী উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে নানা অদ্ভুত উপাদান লক্ষ করা যায়। তাতে একে অবচেতন দৃষ্টি, স্বপ্নিল পরিবেশ ও অলৌকিকত্বের প্রাধান্য থাকে- থাকে অজানা মনকে আবিষ্কারের প্রচেষ্টা। যৌক্তিক দৃষ্টির জায়গায় স্থান পায় অযৌক্তিক বা অসঙ্গত দৃষ্টি।
লালসালু উপন্যাসে পরাবাস্তববাদঃ নিরাসক্ত শিল্পদৃষ্টি এবং শৈল্পিক সংহতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে জীবননিষ্ঠ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এ উপন্যাসে পরাবাস্তববাদের ব্যবহার করেছেন। মহব্বতনগরে মজিদের কার্যকারণ অর্থাৎ বর্তমান থেকে অতীতে আবার অতীত থেকে বর্তমানে সে বিচরণ করেছে পরাবাস্তবতার পথ ধরে। এছাড়াও গ্রামের মানুষের অন্ধ। ধর্মবিশ্বাস অনেকসময়ই যুক্তিতর্কের বাঁধনে বাঁধা সম্ভব নয়। কারণ বাস্তবতা বা Reality-কে এখানে দৃশ্যমান করে দেখানাে সম্ভব নয়। উপন্যাসে বর্ণিত ‘বিশ্বাসের পাথরে খােদাই করা চোখ’ এর কোন বাস্তব ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়- কিন্তু, পরাবাস্তবতার ছোঁয়ায় তা অনেকটাই বাস্তব হয়ে ওঠে। এছাড়াও মজিদের অস্তিত্ববােধের উন্মােচনে ঔপন্যাসিক ভয় ও ভীতি-অনুষঙ্গবাহী শব্দ ও পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহার করেছেন পরাবাস্তবরীতিতে। এমনকি উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে পরাবাস্তববাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। যেমন -
“দূরে ধানক্ষেতে ঝড় ওঠে, বন্যা আসে পথ ভােলা অন্ধ হাওয়ায়, দিগন্ত থেকে গড়িয়ে আসে অফুরন্ত ঢেউ। ধানক্ষেতের তাজা রঙে হাসুনির মায়ের মনে পুলক জাগে।”
বিশ্বসাহিত্যে বিশেষকরে ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান এবং চেক ভাষায় পরাবাস্তববাদের যে ব্যবহার দেখা যায়- তা ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যেও প্রবেশ ঘটে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর হাত ধরে এবং তার প্রথম প্রকাশ লক্ষ করা যায় 'লালসালু' উপন্যাসে।
চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে পরাবাস্তববাদঃ জীবনবােধের প্রাগ্রসরতায় ঔপন্যাসিক চাঁদের অমাবস্যা’য় বিশ্বমনস্ক ও অস্তিত্ববাদী তত্ত্বসংলগ্ন হওয়ায় এ উপন্যাসের অভ্যন্তর পরিচর্যা এবং ভাষাশৈলীতে এসেছে পরাবাস্তবরীতি। যুবক শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান অন্তর্গত সংকট, তার ভয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ দোলাচল মানসিকতায় উপস্থাপিত হয়েছে পরাবাস্তবরীতি। আরেফ আলীর মনােবাস্তবতা বর্ণনাতেও এসেছে তীতিপ্রবাহী শব্দপুঞ্জ। যেমনঃ
“তারপর মাটিতে মুখ গুঁজে সে নিস্তেজভাবে পড়ে থাকে। শীঘ্র তার পিঠ শিরশির করে ওঠে। পিঠে সাপ। চড়েছে যেন।”
সত্যানুসন্ধান আত্মখলনকারী ও বিপন্ন অভিজ্ঞতায় ক্রমসংকুচিত আরেফ আলী সবসময়ই ঔপন্যাসিকের মনঃসংযােগ ও মেধা আকর্ষণ করেছে। ফলে আরেফ আলীর চেতনারবিকাশ ও পরিণতিতেও ব্যবহৃত হয়েছে পরাবাস্তবরীতি। যেমনঃ
“ওপরে ঝলমলে জ্যোৎস্না, কিন্তু সামনে নদী থেকে কুয়াশা উঠে এসেছে। কুয়াশা না আর কিছু, হয়তাে সে ঠিক বােঝে না। হয়তাে একদল সাদা বকরী দেখে, যার শিং-দাঁত-চোখ কিছুই নাই। হয়তাে মনে হয় রাত্রি গা মােড়ামুড়ি দিয়ে উঠে এই, চোখ-ধাঁধানাে অন্তহীন জ্যোালােকে জীবনের আভাস দেখা দিয়েছে।”
কাঁদো নদী কাঁদো উপনাসে পরাবাস্তববাদঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার উপন্যাসে যে জগৎ নির্মাণ করেছেন তা প্রায়ই ববােধ-বুদ্ধির ব্যাখ্যাতীত। সেখানে স্বপ্ন অলৌকিকতা, অদ্ভুত ঘটনা ও রহস্যের বিস্তার। 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসের পর প্রথম থেকেই স্বপ্ন ও জাগরণের দোলাচল-বৃত্তির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এর পরিচয় রয়েছে কথক ‘আমি’র স্বীকৃতিতে, “অনেক কিছুই সে বলে, যার কিছু কানে আসে কিছু কানে আসে না। কিছু বুঝতে পারি কিছু পারি না; মনটার উপর তখন তন্দ্রা উড়ন্ত মেঘের মতাে থেকে ছায়াসম্পাত করেছিল।”
উপন্যাসে সংশয়, সন্দেহ ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক অস্বচ্ছ আস্তরণের ভিতর দিয়ে পুরাে কাহিনিটি দেখা হয়েছে বলে সেখানে পরাবাস্তবতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। উত্তম পুরুযে মুহাম্মদ মুস্তাফার জীবন-কাহিনি বলে যাচ্ছে যে, কথক ‘আমি’, উপন্যাসে তার পরিচয় সুস্পষ্ট নয়। শুধু এটুকু জানা যায় যে, সে মুহাম্মদ মুস্তফার চাচাতাে ভাই। উপন্যাসের ঘটনাবলিতেও তার ভূমিকা নিতান্ত নগণ্য। অন্যদিকে, কুমুরডাঙ্গার উপাখ্যানের কথক লােকটির পরিচয়ও অস্পষ্ট। এই লােকটিকে কথক ‘আমি কখনাে দেখেনি, তার সঙ্গে তার পরিচয়ও হয়নি। সে যথার্থই তবারক ভূইঞা কি- সে বিষয়েও কথক ‘আমি’ নিঃসংশয় হতে পারেনি। ফলে তার বর্ণিত কাহিনিও সংশয়-সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকে।
উপন্যাসে যেসব অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতিক বিষয় ও উপাদান এসেছে সেগুলােও পরাবাস্তবতার অনুসারী। কালু গাজীর অশরীরী আত্মা সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে; বদর শেখের রুগ্ণা স্ত্রীর শরীরে আজরাইলের চিহ্ন দেখা যায়; মােজর মােসলেউদ্দিনের মেয়ে সখিনা খাতুনসহ অনেকেই নদীর কান্না শুনতে পায়। শুধু তাই নয়, কুমুরডাঙ্গার জনগণ, নদীর কান্নার পেছনে ব্যক্তি ও জনগােষ্ঠীগতভাবে সংস্কার ও ভীতির দ্বারা তাড়িত হয়, এলাকায় আসন্ন বিপর্যয়ের ছায়া দেখে। খেদমত উল্লাহর হাতে মুহাম্মদ মুস্তফার নির্যাতিত হওয়ার দৃশ্য দেখে মহাম্মদ মুস্তফার মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে অন্ধকারে এক পরীর সঙ্গে তার কথালাপ হয়। খেদমত উল্লাহর মৃত্যুর পেছনে মীরন শেখ এক ভীষণাকার দৈত্যের অশরীরী মূর্তির লীলা দেখতে পায়।।
এই উপন্যাসে পরাবাস্তবতা সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছে মুহাম্মদ মুস্তফার চরিত্রে। খােদেজার মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতে তবারক ভূইঞার দৃষ্টি অনুসরণ করে মুহাম্মদ মুস্তফা খােদেজার মৃত্যুর যে দৃশ্য অবচেতন কল্পনায় প্রত্যক্ষ করে সে দৃশ্য তাকে এবং পাঠককে এক পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যায়। ক্ষীণতন সখিনা যে বাকাল নদীর রহস্যময় কান্না শােনে তাকে খােদেজার কান্না বলে ভুল করা, রাত্রে সরকারি বাংলাের বারান্দায় বসে তন্দ্রা ও জাগরণের আচ্ছন্নতার মধ্যে শেওলাবৃত ডােবার মতাে পুকুর থেকে খােদেজার মুখ ভেসে উঠতে দেখা, কিংবা চিলেকোঠায় আত্মহত্যা করতে গিয়ে ঘরের মেঝের উপর স্যুটকেস ও লণ্ঠনের দিকে তাকিয়ে কালচে লালরঙের কলিজাকে প্রত্যক্ষ করা এবং নিজের চারপাশে মৃত খােদেজার প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মার উপস্থিতি অনুভব করা ইত্যাদির মাধ্যমে মুহাম্মদ মুস্তফার মনােজগতের যে ছবি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এঁকেছেন তা নিঃসন্দেহে পরাবাস্তবতা-আচ্ছন্ন। সে জগতের চরিত্রের ক্রিয়াকর্ম যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা শাসিত নয়। সেখানে অদ্ভুত ও উদ্ভট সব বিষয় অবচেতন, দৃষ্টি, স্বপ্ন ও কল্পনা, অলৌকিকত্ব, অলীক ও ভয়াল বিশ্বাস ইত্যাদিতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে।
সুতরাং উপযুক্ত আলােচনা থেকে বলা যায়- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু' থেকে পরাবাস্তববাদীরীতির ব্যবহার করেছেন এবং ধীরে ধীরে তা ক্রমবিকাশ লাভ করেছে। ব্যক্তির অন্তর্জটিলতা, অন্তলীন চিন্তা-স্রোতকে সমাজচিন্তার সাথে সমভাবে প্রযুক্ত করে পরাবাস্তবরীতিকে ভিন্নমাত্রা দান করেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ