প্রাচীনকালে ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে গ্রিকদের অবদান আলােচনা কর


প্রশ্নঃ প্রাচীনকালে ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে গ্রিকদের অবদান আলােচনা কর।
অথবা, প্রাচীনকালে ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে গ্রিকদের অবদান মূল্যায়ণ কর।

ভূমিকাঃ এশীয় ও প্রাচ্য দেশিয় সমাজ চিন্তাধারা, সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার থেকে পৃথক এক ইউরােপীয় সভ্যতার অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে বর্তমান সময়ে। এ সভ্যতার আদি উৎপত্তি ছিল গ্রিস। কিন্তু ইউরােপীয় বা গ্রিসীয় বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ গ্রিসীয়দের জাতিগত বা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত নেই। এর স্বরূপ নিহিত রয়েছে গ্রিসীয় সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে। এই সমাজব্যবস্থা প্রাচ্য সমাজব্যবস্থা থেকে পৃথক হলেও তারই অনুসৃত স্বরূপ মিশর, ব্যাবিলন, ক্রিট ও ফিনিশিয়ার সভ্যতার মধ্যে দিয়ে যে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তারই পরিণত রূপ ছিল গ্রিসীয় সভ্যতা।

প্রাচীনকালে ধর্মে গ্রিকদের অবদান

গ্রিকদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল প্রবল এবং তারা ছিল বহু ঈশ্বরবাদীতে বিশ্বাসী। নিম্নে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজাসহ তাদের ধর্মের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলােঃ


(ক) হােমারীয় যুগের ধর্মঃ হােমারীয় যুগে গ্রিসীয় ধর্ম ছিল বহু ঈশ্বরবাদী। কোনাে একজন দেবতা অন্য দেবতার চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী ছিলেন না। তাদের ধারণায় ঈশ্বরগণ মানুষের মতাে ছিলেন, তবে তারা অমর ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তাদের চিন্তায় দেবরাজ ছিলেন বৃষ্টির দেবতা।


(খ) গ্রিকদের বিভিন্ন দেব-দেবীর বিশ্বাসঃ গ্রিকদের কল্পনায় সমস্ত জগৎই দেব-দেবীতে পূর্ণ ছিল। বনে যারা বাস করতেন তাদের দেবীর নাম স্যাটার। ঝরনার দেবীর নাম ছিল নিমফ। এরা ছিলেন সুন্দরী কুমারী। ডায়ােনিসিয়াস ছিলেন তাদের দেবতা। বছরে দু’বার তারা ডায়ােনিনিয়াসের সম্মানে ভােজ দিত। গ্রিকরা যখন নতন ধাতুর কাজ শিখলো তখন কামারকে রক্ষা করার জন্য এক নতুন দেবতার উদ্ভব হলাে, তার নাম ‘হ্যাপফিস্টাস'। সুদর্শন দেবতা এপোলো ছিলেন চারুকলার দেবতা, তার সাথী দেবীর নাম মিউজ। এ্যাফ্রোডিটি ছিলেন প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

(গ) দেবতাদের জীবনযাত্রাঃ গ্রিকরা বিশ্বাস করতাে যে, জিউস, এপােলাে এবং অন্যান্য প্রধান দেবতাগণ গ্রীসের উচ্চতম পর্বত অলিম্পাসে বাস করে। এছাড়া অন্যান্য পর্বতের চূড়ায় ও মেঘের ওপরে হেফিস্টাসের তৈরি সুন্দর সুন্দর প্রাসাদে বসবাস করতেন দেবতারা। গ্রিকদের চেয়ে দেবতাদের জীবনযাত্রা অভিজাতদের জীবনযাত্রার সাথে তুলনীয় ছিল। গ্রিক দেবতারা ছিলেন অভিজাত শাসকদের মতােই নিষ্ঠুর।

প্রাচীনকালে দর্শনে গ্রীকদের অবদান

গ্রিক সভ্যতায় দর্শন চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। এখানে ভাববাদী ও বস্তুবাদী দর্শনের বিবর্তন আমরা দেখতে পাই। নিম্নে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ আলােচিত হলােঃ

(ক) আয়ােনীয় দর্শনঃ গ্রিক দর্শনের উৎপত্তি ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মাইলেসীয় দার্শনিকদের প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হিসেবে। এসব দার্শনিকেরা ছিলেন মাইলেটাস-এর অধিবাসী। শিল্প উৎপাদন উপনিবেশ বিস্তারে সবচেয়ে অগ্রণী, তাই এ যুগে শ্রমের মর্যাদা ছিল, ব্যবহারিক কাজ ও আবিষ্কারের কদর ছিল । এরকম অনুকূল সামাজিক পরিবেশে স্বভাবতই বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদী বিজ্ঞান ও দর্শনের উদয় হয়।


(খ) প্রাকৃতিক জগতের চরিত্রঃ আয়ােনীয় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা থেলিস বলেন যে, পৃথিবীর সবকিছু হয়েছে পানি থেকে। সম্ভবত এ কারণে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, সবকিছুই সমুদ্রের পানিতে বিলীন হয়ে যায় এবং পানি মিশ্রিত কাদা হয়ে মাটিতে পরিণত হয়। অপর আয়ােনীয় দার্শনিক এ্যানােক্সিমান্ডার বলেন- বাতাস দিয়েই সবকিছু তৈরি হয়েছে।

(গ) অধিবিদ্যার প্রবর্তনঃ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী অধিবিদ্যার শেষ হওয়ার আগেই গ্রিক দর্শনে অধিবিদ্যার ' প্রবণতা দেখা যায়। এই অধিবিদ্যার স্থপতি হলেন পিথাগােরাস ও তার অনুসারীগণ। আয়ােনীয় অঞ্চল যখন পারসিক রাজশক্তি দখল করে নেয় তখন পিথাগােরাস ও অন্যান্য গ্রিক দার্শনিকরা ইতালি ও সিসিলিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আয়ােনীয় দর্শনের এখানেই সমাপ্তি । পরবর্তীতে লিউসিপাস ও ডিমােক্রিটাস- এই দুই দার্শনিক পরমাণুতত্ত্বেরও উদ্ভাবন করেন।

(ঘ) সফিস্টদের উদ্ভবঃ মানব চর্চার এ নতুন ধারার প্রথম প্রবক্তাদের বলা হয় সফিস্ট। সফিস্ট শব্দের অর্থ জ্ঞানী। ফলে এদের সম্বন্ধে একটা খারাপ ধারণা বিদ্যমান। তবে একথাও সত্য যে, এ সব সফিস্টদের কেউ কেউ আবার অতি উচ্চ চিন্তাশীল ছিলেন। যেমন প্রােটাগােরাস নামক এক সফিস্ট বলেছিলেন, মানুষকে বাদ দিয়েই সবকিছুর ভালােমন্দ স্থির হয়।

(ঙ) ভাববাদী দর্শনের জন্মঃ পারসিক যুদ্ধে সফল বিজয়ের মধ্যদিয়ে এথেন্সের অভ্যুদয় ঘটে। গ্রিসীয় পারসিক যুদ্ধ শেষ হয় ৪৭৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। কিন্তু ঐ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই এথেন্সের সমৃদ্ধির যুগ অস্তমিত হয়। এ অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের সাথে সাথে গ্রিসীয় দার্শনিক চিন্তা প্রাকৃতিক বস্তুবাদী থেকে মানস বা ভাববাদী স্তরে পর্যবসিত হয়। যায়।

প্রাচীনকালে সাহিত্যে গ্রিকদের অবদান

প্রাচীন গ্রিকদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে অবদান ছিল অনন্য সাধারণ । নিম্নে গ্রিক সাহিত্য আলােচনা করা হলােঃ

(ক) হােমারীয় যুগের সাহিত্যঃ গ্রিক সাহিত্যের আদি প্রকাশ ঘটেছে হােমারের মহাকাব্যে। এ যুগের মহাকাব্যে গ্রিকদের বীরত্বের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। হােমারের সবচেয়ে বিখ্যাত মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসি। হােমারীয় যুগের অবসানে কয়েক শতাব্দীব্যাপী ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ পরিবর্তনের ফলে গ্রিক সমাজে ব্যক্তিসত্তার উদয় ঘটে এবং সাহিত্যেও তার প্রতিফলন ঘটে।

(খ) গীতি কবিতার উদয়ঃ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গাথার স্থানে লিরিক বা গীতি কবিতার উদয় হয়। লায়ার বা বীণা সহযােগে এ সব গীতিকবিতা গীত হতাে। আলসিউস স্যাফোপিন্ডার প্রমুখ ছিলেন বিখ্যাত গীতিকবিতা রচয়িতা।


(গ) গ্রিকদের নাটকের উদ্ভবঃ গ্রিক সাহিত্যের সবচেয়ে সফল ও উল্লেখযােগ্য অধ্যায় ছিল নাটকের উদ্ভব। গ্রিক নাটকের স্বার্থক প্রকাশ ঘটেছিল বিয়ােগান্ত নাটক রচনায়। ডায়ােনিসাস-এর উৎসবে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে গ্রিক নাটকের জন্ম হয়েছিল।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে দর্শন, ধর্ম ও সাহিত্য আলােচনার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিসে যে স্বর্ণযুগীয় সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে একদা স্তিমিতও হয়েছিল। কিন্তু তার ধারা পৃথিবীতে উচ্ছেদ হয়নি। এই সভ্যতার ধারায় পরবর্তী নােমক সভ্যতা এবং ইউরােপীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটে। অদ্যাবধি গ্রিক দর্শনের দাপট সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে এবং খ্যাতির সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক