অথবা, জাতি বলতে কী বুঝ? জাতি গঠনের উপাদান বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয় হলাে জাতি, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদ। এই বিষয়গুলাের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যে সকল রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্তি লাভ করেছে তাদেরর পেছনে প্রধানত কাজ করেছে জাতীয়তার মনােভাব। আর এজন্যই এ বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ।
‘জাতি' শব্দটির উৎসঃ ইংরেজি 'Nation' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে 'Latin' শব্দ 'Natus' থেকে। Natus শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘জন্ম' বা বংশ। ইংরেজি Nation শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলায় ‘জাতি' শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সুতরাং শব্দগত অর্থে একই বংশােদ্ভূত জনসমষ্টিকে জাতি বলে।
জাতির সংজ্ঞাঃ যখন একটি জনসমষ্টি ভাষাগত, ধর্মগত, কৃষ্টিগত, ঐতিহ্যগত এবং রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রেখেএকটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে বসবাস করে তখন তাদেরকে একটি জাতি বলে অভিহিত করা হয়। জাতি হলাে এমন এক জনসমাজ যা ক্রমবিকাশের পথে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অর্থাৎ জাতি হলাে জনসমাজেরই চূড়ান্ত রূপ। নিজ রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমেই জাতি তার পরিপূর্ণতা লাভ করে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ জাতির সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাদের মত বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। তা নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলাে-
অধ্যাপক ম্যাকাইভার (Maclver) বলেন, "জাতি হলাে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্ট, আধ্যাত্ম চেতনার দ্বারা সমর্থিত, একত্রে বসবাস করার সংকল্পবদ্ধ সম্প্রদায়গত মনােভাব সম্পন্ন জনসমাজ, যারা নিজেদের জন্য সাধারণ সংবিধান রচনা করতে চায় ।"
জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) বলেন, একটি মানবসমষ্টির মধ্যে এমন পারস্পরিক সহানুভূতির বন্ধন বিরাজমান, যা অন্যদের মাঝে নেই। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারস্পরিক সহযােগিতা করতে যতটা ইচ্ছুক হয়, অন্যকোনাে মানুষের সাথে ততখানি হতে পারে না। তারা একই সরকারের অধীনে বসবাস করতে চায়। আর এরূপ মানবসমষ্টিকে জাতি বলা যেতে পারে।
লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, “জাতি হচ্ছে জাতীয়তাবােধে উদ্দীপ্ত এবং রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত এমন এক জনসমষ্টি যারা হয় স্বাধীন নতুবা স্বাধীনতাকামী।" “A nation is a nationality which has organized itself into a political body either independent or desiring to be independent.”
মোটকথা, উপযুক্ত সংজ্ঞার ভিত্তিতে বলা যায় যে, গভীরভাবে ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ হলাে জাতীয় জনসমাজ এবং রাষ্ট্রনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জাতীয় জনসমাজ হলাে জাতি। অর্থাৎ 'Nation= Nationality+Political unity' |
জাতি গঠনের উপাদানসমূহঃ একই ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত একটি জনসমষ্টি কি কি শক্তি বা উপাদানের ভিত্তিতে কালক্রমে জাতিতে পরিণত হয় তা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উপাদানের কথা বলেছেন। উপাদানগুলাের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে মতভেদ থাকলেও নিম্নলিখিত উপাদানগুলাে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(১) ভৌগােলিক সান্নিধ্যঃ একই ভৌগােলিক সীমানায় বহুদিন ধরে বেশ কিছুসংখ্যক লােক বসবাস করতে থাকলে অধিবাসীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এক গভীর একাত্মবােধের সৃষ্টি হয়। একই অঞ্চলে বসবাসের ফলে তাদের মধ্যে যােগাযােগ ও আদান-প্রদান সহজ হয়। ফলে অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্যবােধ জাগ্রত হয়। কিন্তু ভৌগােলিক নৈকট্য ছাড়াও জাতি গড়ে ওঠা সম্ভবপর। যেমন-ইহুদীরা প্যালেস্টাইনে আবাসভূমি স্থাপনের পূর্বে বিভিন্ন দেশে বসবাস করে ও তারা একটি জাতীয় জনসমাজ বলে পরিগণিত হতাে।
(২) কুলগত ঐক্যঃ যখন কোনাে জনসমষ্টি বিশ্বাস করে যে, তাদের শিরা-উপশিরায় একই রক্ত প্রবাহিত এবং তাদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অভিন্ন তখনই তাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়। বংশগত ঐক্য জাতি সষ্টির সহায়ক উপাদান হলেও অত্যাবশ্যক নয়। কারণ মার্কিন জাতি বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘জাতি মিশ্রণ হয় নাই ইউরােপে এমন দেশ নাই।'
(৩) ধর্মগত ঐক্যঃ ধর্মগত ঐক্য অনেক সময় জাতি গঠনের সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে। একই ধর্মের লােকজন নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা মনে করে। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে সহজেই ঐক্যবদ্ধ করা যায়। ভারতবর্ষে মুসলমানরা ধর্মকে কেন্দ্র করে প্রথমে জাতীয় জনসমাজ ও পরে জাতিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দেখা যায়, ধর্মগত ঐক্য ছাড়াও অনেক জাতি গঠিত হয়। যেমন-ভারত, চীন ইত্যাদি।
(৪) অর্থনৈতিক সমস্বার্থঃ অর্থনৈতিক স্বার্থ জনগণকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করে। অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে জনগণ বিপ্লবের শামিল হয়েছে এমন উদাহরণ ইতিহাসে বিরল নয়। তবু জাতি গঠনের ব্যাপারে এই উপাদানটিও যথেষ্ট নয়। তা যদি হতাে, তাহলে পরস্পরবিরােধী অর্থনৈতিক স্বার্থযুক্ত শ্রমিকশ্রেণী ও পুঁজিপতিদের একই রাষ্ট্রে বসবাস করা সম্ভবপর হতাে না।
(৫) ভাষাগত ঐক্যঃ একই ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান সহজেই হয়। মানুষের মনের ভাবসমূহ ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। ভাষাগত সমতার জন্য জনগণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একাত্মবােধের সষ্টি হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, ভাষাগত ঐক্য জাতিগঠনের অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে একই ভাষা প্রচলিত থাকার পরেও তারা পৃথক পৃথক জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ।
(৬) রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্যঃ দীর্ঘদিন ধরে কোনাে জনসমষ্টি একই সরকারের শাসনাধীনে থাকলে তাদের মধ্যে ঐক্যবােধ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটিও জাতি সৃষ্টির অপরিহার্য উপাদান নয়। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারের অধীনে বসবাস করা সত্ত্বেও ইহুদী জনসমাজ জাতি সৃষ্টিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়নি।
(৭) দ্বন্দ্ব-কলহের মধ্যকার ঐক্যবােধঃ জাতি গঠনের আর একটি উপাদান হলাে দ্বন্দ্ব ও কলহের মধ্য থেকে ঐক্যবােধের সৃষ্টি হওয়া। বিভিন্ন সামন্তবাদী ও বংশগত দ্বন্দ্ব-কলহ ইউরােপে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বিকাশে প্রভূত সাহায্য করেছিল। এসব দ্বন্দ্বের ফলে গােষ্ঠীসমূহের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে যা জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ কাজ করে।
(৮) একই মানসিকতাবােধঃ একই মানসিকতাবােধ সম্পন্ন মানুষ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ তাদের সকলেই একই মানসিকতা লালন করে এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য জাতি গঠন করে। তাই একই মানসিকতাবােধ জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।
(৯) অবস্থানগত ঐক্যঃ কোনাে স্থানে কোনাে জনগােষ্ঠী দীর্ঘদিন অবস্থান করার ফলে তাদের মধ্যে জায়গা বা ভূমির প্রতি আলাদা টান লক্ষ্য করা যায়। কারণ এতে তারা পরস্পর কাছাকাছি আসে এবং এক সময় জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এভাবে জাতি গঠনের উপাদানের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপযুক্ত উপাদানগুলাে জাতি গঠনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এগুলাের মধ্যে গুরুত্বের তারতম্য রয়েছে। উপাদানগুলাের মধ্যে ভাবগত ঐক্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; অন্যান্য উপাদান না থাকলেও জাতি গঠন সম্ভব। কারণ জাতীয়তাবাদ মূলত এক আত্মগত, ভাবগত এবং অনুভূতিগত বিষয়।
0 মন্তব্যসমূহ