অথবা, দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান বলতে কী বুঝ? দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানের পরিধি বর্ণনা কর।
অথবা, দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান কাকে বলে? দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানের পরিধি বর্ণনা কর
ভূমিকাঃ সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে নৃ-বিজ্ঞান অন্যতম। আক্ষরিক অর্থে নৃ-বিজ্ঞান মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। কিন্তু মানুষ সম্পর্কিত অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির চেয়ে নৃ-বিজ্ঞানের পরিধি অনেক ব্যাপক। বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা মানুষ নিয়ে এই বিজ্ঞানে গবেষণা করা হয়। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের বিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের গবেষণাও নৃ-বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। তাই নৃ-বিজ্ঞানকে মানুষের সামগ্রিক বা পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন বলা হয়।
দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানঃ মানুষের দৈহিক দিক সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানের যে শাখা বিস্তারিত আলােচনা করে তাকে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান বলা হয়। এই শাখা মানুষের দৈহিক আকার-আকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং প্রাণী হিসেবে মানুষের পৃথিবীতে উৎপত্তি, বিবর্তন তথা আদিম ও আধুনিক মানুষের বিভিন্ন প্রকরণ সম্পর্কে আলােচনা করে। মানুষের ক্রমবিকাশের ধারা নির্ণয় করতে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান- অস্থি, কংকাল, মাথা, দেহের গঠন প্রণালি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে। এছাড়া মানুষ পূর্বে কী ছিল, বিবর্তনের মাধ্যমে সে কীরূপ ধারণ করেছে- তা তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করে জীব জগতের মানুষের স্থান কোথায় তা নির্ণয় করে। এভাবে মানুষের বিবর্তনের হারানাে সূত্র (Missing link) খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।
দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান সম্পর্কে বিজ্ঞানী William Harland বলেন, The physical anthropology emerged on as that branch of anthropology which focuses on human a biological organism. দৈহিক নৃবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিম্নের চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয় হয়। যথাঃ
1. The analysis of primitive fossils.
2. Comparative anatomical study of living primates.
3. Observation of living primates in the field.
4. Laboratory experimentation with apes, monkeys, and other animals.
সামগ্রিক আলােচনায় বলা যায় যে, দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান মানুষের বিকাশ সূত্রকে জৈবিক অভিযােজন ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অধ্যয়ন করে।
দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানের পরিধিঃ দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সহজ ভাবে বুঝার জন্য একে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত করে আলােচনার আবশ্যকতা রয়েছে। নিম্নে অনুরূপভাবে আলােচনা করা হলােঃ
(ক) মানব অঙ্গ সংস্থাবিদ্যাঃ এটি মানব দেহ ও তার অংগের গঠনপ্রণালি সম্পর্কে আলােচনা করে থাকে। এ শাস্ত্র মানুষের মধ্যে আকৃতিগত দিক দিয়ে পার্থক্য স্পষ্টরূপে বর্ণনা করে। মানুষের চুলের রং, ত্বকের রং, মাথা, নাক, চোখ ইত্যাদির গঠন কেমন তা আলােচনা করে। কীভাবে বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গ সমন্বিতভাবে দেহের রূপ ধারণ করেছে তা মানবদেহের গঠনতত্ত্বের আলােচনা ও গবেষণার বিষয়বস্তু।
(খ) মানব জীববিদ্যাঃ এটি প্রাণী রাজ্যে মানুষের অবস্থান কোথায় তা নির্ণয় করে। অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের মিল-অমিল খুঁজে বের করা এবং প্রাণী হিসেবে মানুষের প্রকৃতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি বের করা এর প্রধান কাজ। এর কয়েকটি শাখা রয়েছে যথাঃ
(১) নৃ-তাত্ত্বিক বংশগতি বিদ্যা,
(২) কঙ্কাল জীববিজ্ঞান,
(৩) মানব অভিযােজন বিদ্যা।
(গ) মানব জীবাশ্ম বিদ্যাঃ মানব জীবাশ্ম বিজ্ঞান মানুষের ফসিল নিয়েও গবেষণা চালায়। এর বিষয়বস্তু হলাে প্রস্তরীভূত কংকাল, জৈব শিলা, প্রাণী ও গাছপালার ফসিল ইত্যাদি। আবিষ্কৃত ফসিলের বয়স ও যুগ নির্ণয় করা এবং ঐ যুগে ব্যবহৃত হাতিয়ার ও কলাকৌশলকে চিহ্নিত করাই এর উদ্দেশ্য। Clork Howell একে Study of Bone and Stone বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই বলা যায়, জীবাশ্ম বিদ্যা হলাে পাথর সম্পর্কিত আলােচনা।
(ঘ) ফলিত দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানঃ দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানের আর একটি বিশেষ দিক হলাে ফলিত দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান। বৃহৎ জনগােষ্ঠির নমুনা থেকে শরীর পরিমাপ করে বিমান চালকের পেশিশক্তি ও শারীরিক গঠনপ্রণালি প্রাণ রসায়নিক উপায়ে পরীক্ষা করতে বিমানের গাঠনিক বিন্যাস, ককপিট নির্মাণ, অন্যান্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতির সজ্জাকরণ ইত্যাদি কর্ম সম্পন্ন করা হয়। নৃ-বিজ্ঞানের এই শাখা নরদেহের ও তার বিভিন্ন অংগ-প্রত্যঙ্গের আনুপাতিক পার্থক্য নির্ধারণ ও বিশ্লেষণ করে। মানুষের প্রত্যেকটি অঙ্গের তুলনামুলক আলােচনায় একটির তুলনায় অন্যটি কি রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে পরিমাপ করে। অঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও ওজন সম্পকেও এ শাখা আলােচনা করে থাকে। বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন রকমের মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য বিরাজমান রয়েছে তার সঠিক তথ্য অনুসঞ্চালনের জন্য এ শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
পৱিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বিকাশমান দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান প্রধানত দেহ পরিমাপন এবং জাতি শ্রেণিকরণ নির্ভর ছিল। দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানীদের বৈচিত্র্যময় প্রশিক্ষণ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার ফলে বর্তমানে তারা জিনতত্ত্ব ও রক্ত সঞ্চালন বিষয়ক বিদ্যা অধ্যয়ন করছেন, যা পরীক্ষাগারে যাচাই বাছাইয়ের সুযােগ সুযোগ রয়েছে। মূলত এরূপ গুরুত্বারােপের মাধ্যমে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানী দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানকে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান থেকে অন্যান্য জৈবিক বিজ্ঞানের সন্নিকটে এনেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ