প্রশ্নঃ ব্রিটেনে কীভাবে সামন্তবাদী প্রথা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটেছিল? আলােচনা কর।
অথবা, ব্রিটেনে সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদের উত্তরণ কীভাবে ঘটেছিল?
ভূমিকাঃ পুঁজিবাদ একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম, যেখানে ব্যক্তিমালিকানা ও অবাধ মুনাফার নিশ্চয়তা থাকে। এ সমাজব্যবস্থা চিরন্তন বা শাশ্বত নয়। এটা বিকাশ লাভ করে বা গড়ে উঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইংল্যান্ডে এর পূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এরপর ইউরােপ, উত্তর আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে এর বিস্তার ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশ আকারে তা প্রায় সমগ্র বিশ্বকেই গ্রাস করে ফেলে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্তরণঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নানা প্রকার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সফল প্রয়ােগের ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পজগৎ ও অর্থনীতিতে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। উৎপাদন পদ্ধতি, উৎপাদনের উপকরণের পারস্পরিক সম্পর্ক, শিল্পের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক বাণিজ্য, পুঁজিগঠন এবং শিল্পোৎপাদনের আকৃতি ও প্রকৃতিগত অবস্থা; তথা শিল্পের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়। আর এর মাধ্যমে ব্রিটেনের সনাতন সামন্ততন্ত্র ব্যবস্থা ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজের চূড়ান্ত অগ্রযাত্রার দ্বার উন্মােচিত হয়। এর নেপথ্যে যেসকল কারণ ও ঘটনা ঘটেছিল তা নিম্নরূপ-
(১) ব্রিটেনে ম্যানর ব্যবস্থার পতনঃ অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ব্রিটেনের অর্থনীতি ছিল কৃষিপ্রধান। কৃষি ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত, সনাতন এবং এর উৎপাদন ছিল অত্যন্ত কম। জমিতে যেসব শ্রমিক কাজ করত তাদের অধিকাংশ ছিল ভূমিহীন। ভূমিতে তাদের ব্যক্তিমালিকানা স্বীকার্য ছিল না। একটি গ্রাম এবং তার চারপাশের এলাকাকে একত্রে ম্যানর বলা হত। ম্যানরগুলাে অর্থনৈতিক দিক থেকে বহুলাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। প্রকৃতপক্ষে ঐ সমাজ ছিল সম্পূর্ণরূপে সামন্তবাদী সমাজ। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদারগণ ছিলেন এদের একচ্ছত্র অধিপতি। কাজেই একাদশ শতাব্দীতে যখন নগরের বিকাশ ঘটল এবং নগরগুলােতে খাদ্যশস্যের চাহিদা দেখা দিল, তখন ম্যানরের নির্ধারিত জমি থেকে ঐ চাহিদা মেটানাে সম্ভবপর হলাে না এবং ম্যানর ব্যবস্থার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল।
(২) ম্যানর ব্যবস্থা পতনের কারণঃ একাদশ শতাব্দীতে উঠতি নগরগুলােতে ক্রমবর্ধমান খাদ্যশস্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল। নগর বাড়াতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ে। এই সুযোগে নগরে খাদ্য সরবরাহ করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য সামন্ত প্রভুগণ বন-বাদাড়, জলাভমি, পতিত জমি ইত্যাদিতে ফসল ফলানাের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ভূমিদাস নতুন জমিতে চাষ দিতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু তারপরও ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে একাধিক সামন্ত প্রভু ভূমিহীন ও কপর্দকহীন অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক সামন্ত প্রভু দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করে। ফলে একাদশ শতাব্দীতে ম্যানর ব্যবস্থায় যে ভাঙন ধরেছিল, পঞ্চদশ শতাব্দীতে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এবং পশ্চিম ইউরােপে কৃষক মালিকানা ভূমি দাসত্বের স্থান গ্রহণ করে। সামন্ত ম্যানর ভেঙে ছােট ছােট খামার সৃষ্টি হয় এবং কৃষক এগুলাের মালিক হয়।
(৩) ভূমি দাসত্বের বিলােপসাধনঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ভূমি দাসত্ব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছিল। তবে পূর্ব ইউরােপে প্রায় উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সামন্ততন্ত্রের রেশ ছিল। রাজতন্ত্রের উত্থান শুধু সামন্ত প্রভুত্ব নিশ্চিহ্ন করেনি, বরং বুর্জোয়ার বিকাশকেও লালন করেছিল। সামন্ততন্ত্র রাজক্ষমতার প্রতিবন্ধক এবং বুর্জোয়ার পরিপন্থী। কাজেই সামন্ত প্রভুর সাথে বিরােধেও রাজতন্ত্রের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন, অর্থাৎ সামন্ত ক্ষমতা খর্ব করা। অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য বুর্জোয়া ও রাজতন্ত্র সামন্ততন্ত্রের সাথে বিবাদে পরস্পরের প্রতি সমর্থন ও সহায়তা প্রদর্শন করেছিল।
(৪) মাঝারি বিত্তের বুর্জোয়া হওয়ার আকাঙক্ষাঃ ত্রয়ােদশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে বুর্জোয়া আখ্যাটি মধ্যবিত্তের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বুর্জোয়া বলতে মাঝারি বিত্তের লােক বুঝাতাে যাদের আয়ের পথ জমি নয়, বরং ব্যবসায়-বাণিজ্য। জনমনে জমির আভিজাত্যের ধারণা তখনও বদ্ধমূল। যারা জমির মালিক একমাত্র তারা বংশপরম্পরায় অভিজাত বলে স্বীকৃত ছিল। জমির মালিকানা আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল, কিন্তু ব্যবসায়ে অর্জিত বিত্ত নয়। ফলে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ার বংশমর্যাদা ছিল না, ছিল না জমির আভিজাত্যের গৌরব। কিন্তু তাদের মাঝে এই গৌরব ও মর্যাদা অর্জনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল।
(৫) সামন্ততন্ত্রের অবসানঃ সামন্ততন্ত্রের অবসান হলে জমির ব্যক্তিগত মালিকানার পথে প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয় এবং উঠতি বুর্জোয়ারা আভিজাত্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় জমি ক্রয় করে জমির মালিক হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে বুর্জোয়ারা নিজ বলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার মতাে আর্থিক সংগতি অর্জন করে এবং অভিজাত বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হয়। দু’টো ধাপে রূপান্তর ঘটে। ষােড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরােপে শিল্পবিপ্লব ঘটে এবং মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া বাণিজ্যিক পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হয়।
(৬) শিল্পবিপ্লবঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হলে বাণিজ্যিক পুঁজিপতি শিল্প পুঁজিপতিতে উন্নীত হয় এবং ব্রিটেনে তথা সমগ্র ইউরােপে শিল্পসমাজের গােড়াপত্তন হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজে প্রবেশ করে। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে, ইউরােপে পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্রের অবদান সবচেয়ে বেশি। সামন্তসমাজ ছিল দাসসমাজ অপেক্ষা অনেক উন্নত। সামন্ত সমাজে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে সামন্ত সমাজব্যবস্থা ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে উঠেছিল।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, সামন্তবাদের গর্ভে পুঁজিবাদের জন্ম- একথা প্রায় সর্বজনবিদিত। কেননা সামন্তপ্রথা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখনই পুঁজিবাদের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। তবে স্মরণ রাখা উচিত, সামন্তসমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উনবিংশ এমনকি বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কম-বেশি টিকে ছিল, যদিও অষ্টাদশ শতক থেকেই পুঁজিবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সুতরাং ক্ষয়প্রাপ্ত সামন্তপ্রথার শূন্যস্থান পূরণ করে যে নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে তাই হলো পুঁজিবাদ।
0 মন্তব্যসমূহ