সমাজবিজ্ঞানের সাথে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সমাজবিজ্ঞানের সাথে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক আলােচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানের সাথে সমাজকল্যাণের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান মানবসমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান যেখানে সমাজের এক একটি বিষয় বা দিক নিয়ে আলােচনা করে, সমাজবিজ্ঞান সেখানে নিরপেক্ষভাবে সমাজের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলােচনা করে। এজন্য অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে সমাজকল্যাণ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞানের কিছু বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

সমাজকল্যাণে সাথে সমাবিজ্ঞানের সম্পর্কঃ সমাজকল্যাণ একটি সমন্বয়ধর্মী ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজকল্যাণ এর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি অন্যান্য বিজ্ঞান হতে গ্রহণ করে সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে নিজস্ব বিজ্ঞান গড়ে তুলেছে। সুতরাং অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গেও সমাজকল্যাণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। নিম্নে সমাজকল্যাণের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক প্রদত্ত হলােঃ


(১) সংজ্ঞাগত সম্পর্কঃ সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞানই হলাে সমাজবিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, সমাজবিজ্ঞান সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্কের বিষয় অধ্যয়ন করে। সুতরাং দেখা যায় যে, সমাজবিজ্ঞান প্রথা ও প্রতিষ্ঠান এবং এদের পেছনে যেসকল ধারণা কাজ করছে সে সম্পর্কে আলােচনা করে। সমাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান দান করে। অপরপক্ষে সমাজকল্যাণ এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান ও পেশা যা সামাজিক সমস্যা সমাধান করে সমাজের সর্বাঙ্গীন কল্যাণসাধনে সহায়তা করে। সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনের জন্য একজন কর্মীকে সামাজিক সমস্যা, সামাজিক কাঠামাে, সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রথা প্রভৃতি সম্পর্কে বিষদভাবে জানতে হয়। অতএব বলা যায়, উভয়ের আলােচ্য বিষয় এক ও অভিন্ন।

(২) লক্ষ্যগত সম্পর্কঃ সমাজকল্যাণ এবং সমাজবিজ্ঞান উভয়ের লক্ষ্য সমাজের কল্যাণ ও প্রগতি নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনে সমাজবিজ্ঞান সমাজস্থ সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে। অপরদিকে সমাজকল্যাণ সমাজবিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞানকে পুঁজি করে সামাজিক সমস্যার সমাধানপূর্বক সমাজের উন্নতি বিধানে সক্ষম হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে উভয় বিজ্ঞানই একে অপরের পরিপূরক।


(৩) বৈশিষ্ট্যগত সম্পর্কঃ সমাজ সম্পর্কিত সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উভয় বিজ্ঞানেরই বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান সমাজের এক একটি ইউনিট নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ সমাজের সমগ্র দিক নিয়ে আলােচনা করে। অর্থাৎ এ দু’টি বিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

(৪) সাদৃশ্যগত সম্পর্কঃ সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞান উভয়েরই প্রতিপাদ্য বিষয় সমাজ হওয়ার কারণে কেউ কেউ এ দু’টি শাস্ত্রকে একই শাস্ত্রের দু'টি দিক অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানকে তাত্ত্বিক এবং সমাজকল্যাণকে ব্যবহারিক দিক মনে করে। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, উভয়ের সাদৃশ্যগত সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।

(৫) মৌলিক উৎস হিসেবেঃ সমাজকল্যাণের জ্ঞানের মৌলিক উৎস হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের সংগে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কারণ সমাজ সম্পর্কিত মৌলিক ও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন ব্যতিত সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জন আদৌ সম্ভব নয়।


(৬) সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজকর্মীদের নির্দেশনা দান করেঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বিষয় অর্থাৎ সমাজস্থ মানুষের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, প্রেষণা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবােধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। আধুনিক সমাজকল্যাণে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করার জন্য তিনটি মৌলিক ও তিনটি সহায়ক পদ্ধতি প্রয়ােগ করা হয়। এসব পদ্ধতি প্রয়ােগ করতে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজকর্মীকে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে।

(৭) সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধি দান করে সমাজকল্যাণঃ সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান দান করে সমাজ বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান প্রদত্ত জ্ঞান নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে মানবকল্যাণে প্রয়ােগ করে সমাজকল্যাণ। সুতরাং সমাজবিজ্ঞান প্রদত্ত জ্ঞানকে পরিপূর্ণতা দান করার ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যঃ সমাজকল্যাণ ও সমাজ বিজ্ঞানের মধ্যে অবিচ্ছেদ সম্পর্ক থাকলেও এদের মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নে তুলে ধরা হলােঃ

(১) ধরনগত পার্থক্যঃ সমাজবিজ্ঞান একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান যা সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করেই ক্ষান্ত থাকে। কিন্তু সমাজকল্যাণ একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কৌশল প্রয়ােগের জন্য সমাজকল্যাণ সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করে।

(২) পরিধিগত পার্থক্যঃ সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও উভয়ের মধ্যে পরিধিগত পার্থক্য লক্ষণীয়। কেননা সমাজবিজ্ঞান সমাজ সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান। এর পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত । কিন্তু সমাজ সম্পর্কিত সকল বিষয় সমাজকল্যাণের আওতাভুক্ত নয়। ফলে সমাজকল্যাণের পরিধি সমাজবিজ্ঞান অপেক্ষা সংকীর্ণ।


(৩) উৎপত্তিগত পার্থক্যঃ সমাজ সৃষ্টির শুরু থেকেই মূলত সমাজবিজ্ঞানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এদিক থেকে সমাজবিজ্ঞান অতি প্রাচীন। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের জটিল সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের উৎপত্তি। অতএব দেখা যায় যে সমাজবিজ্ঞানের তুলনায় সমাজকল্যাণ অত্যন্ত নবীন সামাজিক বিজ্ঞান।

(৪) আন্তঃনির্ভরশীলতাঃ সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য। সমাজিকল্যাণ সমাজবিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সমাজের সামগ্রিক বিশ্লেষণে সমাজকল্যাণের জ্ঞান অপরিহার্য নয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিষয়বস্তু, আলােচনার পদ্ধতি এবং প্রকৃতিগতভাবে সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও মানবকল্যাণে উভয়ে সহায়ক এবং পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। শরীরের গঠনতত্ত্ব না জেনে যেমন চিকিৎসা ও রােগ নির্ণয় করা যায় না, তেমনি সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া সামাজিক সমস্যা সমাধান করা যায় না। এক কথায় উভয়ই মানব কল্যাণে সদা নিয়ােজিত থাকে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক