অথবা, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক কীরূপ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ আইন মানব সমাজের দর্পণস্বরূপ। অধ্যাপক হল্যান্ড বলেন, “আইন হল মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এমন কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত হয়।” আইনের যথার্থ স্বরূপ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার ওপর নির্ভরশীল। বস্তুত আইন হলাে মানুষের আচার-ব্যবহার ও চিন্তাধারার বিধিবদ্ধ রূপ। আর নৈতিকতা সমাজ দ্বারা সৃষ্ট। সেটা পালনে সামাজিক চাপ থাকলেও বলবদ করার জন্য শাস্তি প্রদানের কোন প্রতিষ্ঠান থাকেনা। যেটা আইনের ক্ষেত্রে থাকে।
আইন ও নৈতিকতার পার্থক্যঃ সমাজে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে সকল বিধি-বিধান চালু করা হয় সেগুলিকে আইন বলা হয়। আর নীতির অনুসরণ ও অনুকরণ করা এবং এর পরিপন্থী কোনাে কাজ না করাকে নৈতিকতা বলে। আইন ও নৈতিকতা বর্তমানে বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য নির্দেশ করে। নিম্নে তা আলােচনা করা হলােঃ
(১) বিষয়বস্তু ও প্রক্রিয়াগত পার্থক্যঃ রাষ্ট্রনৈতিক আইনের তুলনায় নৈতিকতার পরিধি অনেক ব্যাপক। আইন কেবল মানুষের বহিঃজীবন ও বাহ্যিক আচার-আচারণ নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি প্রভৃতি অন্তঃজীবনের ক্রিয়াকলাপের ওপর এর কোনাে এখতিয়ার নেই। পক্ষান্তরে নৈতিক বিধান মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মন, চিন্তা, অনুভূতি প্রভৃতি সব কিছুই নৈতিকতার এখতিয়ারভুক্ত।
(২) অনুমােদনগত পার্থক্যঃ রাষ্ট্রীয় আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির অনুমােদন থাকে। তাই তা বাধ্যতামূলকভাবে বলবৎ হয়। কিন্তু নৈতিকতার পেছনে এরকম কোনাে শক্তির সমর্থন নেই। তাই নৈতিকতা আবশ্যিকভাবে কার্যকর হয় না।
(৩) মানদণ্ডের পার্থক্যঃ নীতিগতভাবে অন্যায় বা আইনের চোখে তা অপরাধ নাও হতে পারে। যেমন মদ্যপান নীতিবিরুদ্ধ, কিন্তু বেআইনি নয়। আবার আইনের চোখে যা দণ্ডনীয়, নৈতিক বিচারে তা দূষণীয় নাও হতে পারে। যেমন আমাদের দেশে রাস্তার ডানদিকে গাড়ি চালানাে আইনবিরুদ্ধ, কিন্তু নীতিবিরুদ্ধ নয়।
(৪) দেশ-কালভেদেঃ নৈতিকতা মােটামুটিভাবে সব দেশের এবং সর্বকালের। মানুষের ইচ্ছানুসারে এগুলাে পরিবর্তিত হয় না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় আইন আপেক্ষিক এবং দেশ ও কালভেদে বিভিন্ন। আবার প্রয়ােজনবােধে মানুষ তা সংশােধন বা বাতিল করতে পারে।
(৫) প্রকতিগত পার্থক্যঃ প্রকৃতিগত বিচারেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। নীতিশাস্ত্র সকল কাজ বা চিন্তাকে ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির মানদণ্ডে বিচার করে থাকে। অপর পক্ষে সুবিধা-অসুবিধার মানদণ্ডে আইন প্রণীত হয়।
(৬) রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতেঃ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে আইন ও নৈতিকতার মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। দেশের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাই রাষ্ট্র অস্তিত্বের পক্ষে আবশ্যক এমন আইনও সৃষ্টি করতে পারে যা ন্যায় ও নীতির বিরােধী। তবে যুদ্ধকালীন বা কোনাে বিশেষ অবস্থায় সাময়িকভাবে রাষ্ট্র এ রকম নীতিজ্ঞানবিরােধী আইন প্রণয়ন করে। স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্রের নীতিগহিত আইন সমর্থন করা যায় না।
(৭) শাস্তি সম্পর্কিত পার্থক্যঃ শাস্তির ক্ষেত্রে আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আইন লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্র আইন ভঙ্গকারীকে শাস্তি প্রদান করতে পারে। বল প্রয়ােগ করে সরকার আইন মানতে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু নৈতিক বিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তির কোনাে ভয় নেই। এ জন্য সর্বোচ্চ জনগণের নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়।
(৮) উৎসঃ নৈতিকতা ও আইন একই উৎস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। নৈতিকতা যেমন- ধর্ম, প্রথা, ও ন্যায়বােধকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তেমনি আইন ও ধর্ম, প্রথা ও ন্যায়বােধকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে।
(৯) পারম্পরিক প্রভাবিকীকরণঃ আইন ও নৈতিকতা একে অপরকে প্রভাবিত করে। আইন অনেক সময় কু-নীতিকে দূর করে সু-নীতি প্রতিষ্ঠিত করে, আবার ন্যায় অন্যায়ের প্রচলিত ধারণা ও অনেক সময় আইনে পরিণত হয়।
(১০) বিষয়বস্তুঃ বিষয়বস্তুর দিক থেকেও আইন ও নৈতিকতার মাঝে সম্পর্ক বিদ্যমান। আইন ও নৈতিকতা উভয়ই মানুষকে কল্যাণ ও ভালাের পথে আসতে অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত করে।
আইন ও নৈতিকতার সম্পর্কঃ আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। এরা পরস্পর পরিপূরক। নিম্নে আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক আলােচনা করা হলাে-
(১) আইন ও নৈতিকতার লক্ষ্য এক ও অভিন্নঃ আইন ও নৈতিকতা উভয়ই সমাজে বসবাসরত মানুষের কল্যাণসাধন করে। আইন জনগণের কল্যাণসাধন করে মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর নৈতিকতা মানুষের মনােজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে।
(২) আইননীতিবােধকে প্রভাবিত করেঃ আইন অনেক সময় সমাজের নীতিবােধকে প্রভাবিত করে দেশের নৈতিক অবস্থার উন্নতির ব্যবস্থা করে। পূর্বে সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি নীতিসম্মত ছিল। কিন্তু আইন করে এই সকল প্রথা দণ্ডনীয় করার পর এগুলাে সমাজে ক্রমশ কেবল বেআইনি নয়, নীতিবিরােধী বলে স্বীকৃত হলাে।
(৩) নীতিজ্ঞান আইনকে প্রভাবিত করেঃ সমাজের নীতিজ্ঞান আইনকে প্রভাবিত করে। নীতিবােধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে আইন প্রণয়ন করা হয়। সেইজন্য আইনকে একটি দেশের নৈতিক মানের পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। কোনাে দেশের নৈতিক মূল্যবোেধ উন্নত হলে তার আইন ব্যবস্থাও উন্নত হয়ে থাকে।
(৪) নৈতিকতার ন্যায় আইনও সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলঃ সমাজের পরিবর্তন হলে সেই সাথে নৈতিকতারও পরিবর্তন ঘটে। নতুন ধরনের আইনের প্রভাবে নৈতিকতার মানদন্ড পরিবর্তিত হয়। যেমন- পুঁজিবাদী সমাজের নৈতিক মানদন্ড এক ধরনের আবার সমাজতান্ত্রিক সমাজের মানদন্ড অনুরূপ। এ কারণে আইনও ভিন্ন প্রকৃতির।
(৫) আইন ও নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই সমাজ জীবনকে সমৃদ্ধি দান করেঃ আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেই সমাজ জীবনের উৎকর্ষ সাধিত হয়। মানুষের নৈতিকতা যদি উচ্চমানের না হয় তাহলে কোন রাষ্ট্রের আইন উন্নতমানের হতে পারে না। যে দেশের জনগণের মূল্যবােধ নিম্নমানের সে দেশের আইনও নিম্নমানের।
(৬) রাষ্ট্রের বিশেষ আইনঃ রাষ্ট্রে এমন অনেক আইন রয়েছে যেগুলাে নৈতিকতাবহির্ভূত হলেও রাষ্ট্র কর্তৃক পালিত ও কার্যকর হয়ে থাকে। যেমন- রাস্তার ডানে বামে অসংযতভাবে গাড়ি চালনা করা নৈতিকতা বিরুদ্ধ নয় কিন্তু তথাপি এটা বেআইনী।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত সুনিবিড়। সত্যিকার তার্থে, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি থেকেই আইনের জন্য হয়। নৈতিকতা বিরােধী আইন কখনও কার্যকর করা সম্ভব নয়। যখন আইন নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তখনই এটা গণসমর্থন লাভ করে। ফলে দুর্নীতিমূলক আইন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী হয়ে পড়ে।
0 মন্তব্যসমূহ