টিকা লিখঃ খেলাফত আন্দোলন
উপস্থাপনাঃ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশে খেলাফত আন্দোলন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। মুসলমানদের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ বেনিয়া গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। এ আন্দোলন তাৎক্ষণিকভাবে সফলতা বয়ে না আনলেও এ আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভ ত্বরান্বিত হয়।
খেলাফত আন্দোলনের পটভূমিঃ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরােপে যে মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়, ঐ যুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রভৃতি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। এ যুদ্ধে তুরস্ক ও জার্মানি পরাজিত হয়। উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলন তুরস্কের এ অবস্থা থেকেই আরম্ভ হয়।
খেলাফত আন্দোলনঃ খেলাফত যে একটি প্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠান এবং আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম তা মুসলমানরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। এরই ফলে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে Pan Islamism ভাবধারার প্রভাব প্রকাশ পায়। তারা ইসলামকে দেখেছেন একটি বিশ্বজনীন মতাদর্শ হিসেবে। কাজেই বিশ্বের সর্বত্র ইসলামী শক্তির জাগরণ তাদের কাম্য ছিল। এদিকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ রদ ঘােষণার মধ্য দিয়ে মুসলমানগণ বুঝতে পারে, এ সরকার কখনােই মুসমলানদের পক্ষে নয়। ফলে তারা বিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলেন। এ আন্দোলন তুরস্কের খেলাফত রক্ষা নামে পরিচালিত হয় বলে একে ‘খেলাফত আন্দোলন' বলা হয়।
খেলাফত আন্দোলনের ফলাফলঃ নিম্নে খেলাফত আন্দোলনের ফলাফল ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলোঃ
১. হিন্দু মুসলিম ঐক্য ব্যাহতঃ খেলাফত আন্দোলন ভারতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করে এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের সম্ভাবনা চিরদিনের মতাে তিরােহিত হয়।
২. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ভবঃ খেলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনের সমর্থকদের মতানৈক্যের ফলস্বরূপ হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ভব হয়।
৩. মুসলমানদের অগ্রগতি ব্যাহতঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, খেলাফত আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের উন্নতি অগ্রগতি ভীষণভাবে ব্যাহত হয়।
৪. রুদ্ররােষে পতিতঃ এ আন্দোলনের ফলে মুসলমানগণ ইংরেজদের রুদ্ররােষে পতিত হয়।
৫. নব উদ্দীপনা লাভঃ প্রায় দু'শ বছরের নির্যাতিত নিষ্পেষিত মুসলমানগণ এ আন্দোলনের ফলে নব উদ্দীপনা লাভ করে।
৬. রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধিঃ খেলাফত আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
৭. ইসলামী উম্মাহকেন্দ্রিক মনােভাব সৃষ্টিঃ খেলাফত আন্দোলন গােটা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মনােভাব বিকশিত করে তােলে। ফলে ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।
৮. গণআন্দোলনের পদ্ধতি শিক্ষাঃ ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেন, খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম সুদূরপ্রসারী ফল হলাে এ আন্দোলন মুসলমানদের গণআন্দোলন গড়ে তােলার নিয়ম কানুন শিক্ষা দেয়।
৯. দাবি আদায়ের চেতনা বৃদ্ধিঃ এ আন্দোলন মুসলমানদের বিপ্লবের মশাল ধারণ করে নিজেদের দাবি আদায়ে সচেতন করে তােলে।
১০. স্বাধীনতা লাভের প্রেরণাঃ স্যার সলিমুল্লাহ বলেন, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে ও স্বাধীনতা আন্দোলন সুসংহতকরণে খেলাফত আন্দোলনের বিপুল প্রভাব অনস্বীকার্য।
১১. স্বাবলম্বী হওয়ার দীক্ষা লাভঃ আন্দোলনের ফলে মুসলমানরা স্বাবলম্বী হওয়ার দীক্ষা লাভ করে।
১২. পৃথক আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তাঃ এ আন্দোলনের ফলে খেলাফত আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীরা তাদের জন্য পৃথক এলাকা ও আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। পরবর্তীতে দাবি আদায়ের জন্য পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার করা হয়।
উপসংহারঃ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে খেলাফত আন্দোলন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ আন্দোলনের মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিল। এ জন্যই তদানীন্তন হিন্দু নেতৃত্ব খেলাফত আন্দোলনে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি।
0 মন্তব্যসমূহ