অথবা, সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যা জান লিখ।
ভূমিকাঃ পাশ্চাত্য সভ্যতার চিন্তাজগতে বিবর্তনই হচ্ছে সমাজবিজ্ঞান, যা ধর্ম থেকে দর্শনের মধ্যদিয়ে বিজ্ঞানে উন্নীত হয়। তাই সমাজচিন্তার ইতিহাস যেমন যথেষ্ট প্রাচীন, তেমনি একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের সত্তা লাভের ইতিহাস একান্তই সাম্প্রতিক। ফরাসি বিপ্লবােত্তর সামাজিক অনুশাসন ভঙ্গ ও সমাজের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ প্রচেষ্টার দর্শন হিসেবে প্রথমদিকে সমাজবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম 'Sociology' প্রত্যয়টি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের গােড়াপত্তন করেন।
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশঃ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় সমাজবিজ্ঞান সর্বকণিষ্ঠ। অগাস্ট কোঁৎ-এর সমাজবিজ্ঞান প্রত্যয় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, চিন্তার আদি উন্মেষ থেকেই সমাজ সম্পর্কে মানুষ ভাবতে থাকে। যেমন হ্যারি এলমার বার্নস বলেন, ‘লােককাহিনী থেকে বৈজ্ঞানিক যুগ পর্যন্ত সামাজিক চিন্তাধারার ব্যাপ্তি।' নিম্নে সমাজচিন্তার পটভূমি তুলে ধরা হলাে:
(১) হামুরাবি সনদঃ খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে মানুষের লিখিত সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রাচীন হামুরাবি সনদে প্রাচীন ব্যাবিলােনিয়ান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন বিধৃত আছে। এতে সমাজের বিভিন্ন মানুষের অধিকার ও কর্তব্যের সংক্ষিপ্ত অথচ পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়, যা সমাজদর্শনের পরিচয় দান করে।
(২) প্লেটোঃ গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার 'Republic' গ্রন্থে সমাজ সম্পর্কে যেসব তত্ত্বের অবতারণা করেন তার মাধ্যমে সমাজের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তার কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের সামাজিক গড়ন ও শ্রেণি সম্পর্কে চিন্তা ছিল সমাজতাত্ত্বিক এবং সমাজ মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ন উপাদান।
(৩) এরিস্টটলঃ প্লেটোর সুযােগ্য ছাত্র এরিস্টটল তার 'Politics' গ্রন্থে প্লেটোর তুলনায় অনেকটা বাস্তবভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রিয় কাঠামাের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন, যা সমাজবিজ্ঞানের জগতে গুরুত্বপূর্ন উপাদান হিসেবে বিবেচিত।
(8) ম্যাকিয়াভেলিঃ ইটালির দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি তার "Prince' গ্রন্থে একজন শাসকের যে গুণাবলি এবং রাষ্ট্রের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী শাসকের যে কার্যাবলির সুপারিশ করেন তা খুবই বাস্তবধর্মী। সমাজ সম্পর্কিত তার বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে আধুনিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়।
(৫) ভিকোঃ সমাজ যে একটি নির্দিষ্ট ধারায় বিবর্তিত হয় এ কথার বৈজ্ঞানিক রূপদান করেন ভিকো। তিনি তার দর্শনের নাম দেন 'The New Science' বা নতুন বিজ্ঞান। এজন্য অনেকে ভিকোকেই পাশ্চাত্য জগতে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলেন। তিনি সমাজ বিবর্তনের ধারায় তিনটি যুগ লক্ষ্য করেন। যথা: (১) দেবতাদের যুগ (২) যােদ্ধাদের যুগ ও (৩) মানুষের যুগ।
(৬) ইবনে খালদুনঃ মুসলিম জগতের মনীষী ইবনে খালদুন তার ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক শক্তিসমূহের ব্যাখ্যা দেন। ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তার আলােচনা এতটাই সমাজতাত্ত্বিক যে তাকে অনেকে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বলেন।
(৭) হেগেলঃ হেগেল সর্বপ্রথম সমাজ ও রাষ্ট্রের পার্থক্য দেখিয়ে বলেন, মানুষের আর্থিক তাগিদে সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজের ধারণার এভাবে পৃথকীকরণের মাধ্যমেই সমাজ সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার বিকাশ হতে থাকে।
(৮) মন্টেস্কুঃ সমাজচিন্তায় ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিজ্ঞানের পটভূমি থেকে ইতিহাস রচনা করেন। 'The spirit of the laws' গ্রন্থে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, কীভাবে ভৌগােলিক পরিবেশ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজচেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
(৯) অগাস্ট কোঁৎঃ ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা ও সমাজকাঠামােতে ফরাসি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ও ফলশ্রতি অগাস্ট কোঁৎ-এর চিন্তা ও তত্ত্বকে প্রভাবিত করে। তিনি তৎকালীন ফ্রান্সের বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতাকে অবলােকন করে সমাজ পুনর্গঠনের চিন্তায় মনােনিবেশ করেন। এবং সমাজ বিশ্লেষণের জন্য 'Social Physics' নামে এক স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের জন্ম দেন। পরে ১৮৩৯ সালে এটিকে 'Sociology' নাম দিয়ে এক নবতর বিজ্ঞানের গােড়াপত্তন করেন । তিনি তার 'Positive Philosophy' গ্রন্থে সমাজের তিনটি স্তরের কথা বলেন। যথা: ধর্মতান্ত্রিক স্তর, দার্শনিক স্তর এবং দৃষ্টবাদ। মূলত অগাস্ট কোঁৎ হলেন সমাজবিজ্ঞানের জনক।
(১০) হার্বার্ট স্পেনসারঃ একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ইংরেজ সমাজচিন্তাবিদ স্পেনসারের নাম বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। তিনি বিজ্ঞানের দুটি ভিন্নতর শাখা পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান এই দুই ক্ষেত্র হতে ভিন্ন ভিন্ন সূত্র গ্রহণ করে সমাজকে একটি সচেতন ও ক্রমবিকাশমান সত্তা হিসেবে প্রমাণ করেন এবং সমাজবিজ্ঞানে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগের ভিত স্থাপন করেন।
(১১) কাল মার্কসঃ কার্ল মার্কস ফরাসি বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবােত্তর ইউরােপীয় সমাজকাঠামাের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্বারা প্রভাবিত হন। মার্কসের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবােধের তত্ত্ব মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভবের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। সমাজের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা তথা সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে মার্কর্সীয় চিন্তাধারাই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং স্থায়ী।
(১২)ডুরখেইমঃ একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠায় ডুরখেইমের অনন্য অবদান রয়েছে। ডুরখেইম তাঁর "The Division of Labour in Society' এবং 'Suicide' গ্রন্থে সমাজ বিশ্লেষণে বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। তিনি সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার সূত্রপাত ঘটান। তাই সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে তার অবদান অনস্বীকার্য।
(১৩) ম্যাক্স ওয়েবারঃ ওয়েবার ব্যক্তিকে সমাজ গবেষণার একক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার 'The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism' গ্রন্থটি সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় এক নতুন মাত্রা যােগ করে। ওয়েবারের আমলাতন্ত্রের ও নেতৃত্বের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞানের নবদিগন্ত উন্মােচন করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পেছনে বিভিন্ন যুগের সমাজচিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকে সমাজচিন্তার উদ্ভব হলেও সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত সমাজবিজ্ঞানকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা গেলেও সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে ক্রমবিকাশের সূত্র ধরে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।
0 মন্তব্যসমূহ