জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থার বিবরণ দাও


প্রশ্নঃ জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থার বিবরণ দাও।
অথবা, জাহেলিয়া যুগের ধর্মীয় অবস্থা আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গোটা বিশ্ব ছিল জাহেলিয়াতের অজ্ঞতা, অপসংস্কৃতি, ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বেহায়াপনার তিমির অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঐতিহাসিকগণ এ চরম বীভৎস যুগকে ‘The age of ignorance’ বা অজ্ঞতার যুগ বলে অভিহিত করেছেন।

জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থাঃ নিম্নে ইসলাম পূর্ব জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থা তুলে ধরা হল-

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মব্যবস্থাঃ ইসলামের পূর্বেকার আরবের ধর্মব্যবস্থা ছিল বিকৃত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও নীতিগৰ্হিত। তাদের অধিকাংশ লোকই ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা, ঘৃণ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা, দেবদেবী ও পাহাড়-পর্বতের পূজায় লিপ্ত ছিল। ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন- The religion of the Arabs as well as their political life was on a thoroughly primitive level.


প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীঃ জাহেলী যুগে আরব দেশে প্রধানত যেসব ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করতো তারা হলো- ক. পৌত্তলিক, খ, জড়বাদী, গ. দাহরিয়া, ঘ. হানীফ, ঙ. ইহুদি, চ, খ্রিস্টান।

পৌত্তলিকতাঃ মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের পূর্ব থেকেই পৌত্তলিকতা ছিল আরবদের মাঝে সর্বাধিক প্রসারিত ধর্ম। বিভিন্ন জাতি যেমন- আদ, সামুদ, জাদিস, আমালিকা প্রভৃতি গোত্র ছিল পুরোপুরি পৌত্তলিক। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেন, ব্যাপক অর্থে আরব জনগণ ছিল পৌত্তলিক। তাদের ধর্ম ছিল পৌত্তলিকতা এবং বিশ্বাস ছিল আল্লাহর পরিবর্তে অদৃশ্য শক্তির কুহেলিকাপূর্ণ ভয়ভীতি।

মূর্তি পূজাঃ জাহেলিয়া যুগে আরবগণ বিভিন্ন মূর্তির উপাসনা করত। এ মূর্তিগুলোর গঠন আকৃতি উপাসনাকারীদের ইচ্ছানুযায়ী তৈরি করা হতো।

প্রধান দেবদেবীঃ আরবদের অধিকাংশ নানা ধরণের দেবদেবীর পুজা করত। এসব দেবদেবীর মধ্যে লাত, মানাত, উযযা ছিল প্রধান। লাত, মানাত ও উযযাকে একত্রে আল্লাহর কন্যা বলে প্রচার করা হতো। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস বলেন, আল লাত ছিল তায়েফে বসবাসকারীদের দেবী। যা ছিল চতুষ্কোণাকার একটি পাথর। মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত কুদায়েফে ভাগ্যদেবী মানাতের মন্দির অবস্থিত ছিল। আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা কালোপাথরের মূর্তিকে অধিক সম্মান করত। মক্কাবাসীদের নিকট সমাদৃত আল উযযা- নাখলা নামক স্থানে তিনটি বৃক্ষ বেষ্টিত মন্দিরের দেবী ছিল।


হোবলঃ পবিত্র কা’বায় স্থাপিত প্রধান দেবতা ছিল হোবল। যার অর্থ, ভূতপ্রেত। মুহাম্মদ (স) মক্কা বিজয়ের পর অন্যান্য মূর্তির সাথে হোবলকেও ধ্বংস করেন। মূলত হোবল ছিল কুরাইশদের গোত্রীয় দেবতা।

অন্যান্য দেবদেবীঃ উপরোক্ত দেবদেবী ছাড়াও প্রাক ইসলামী যুগে- ওয়াদ, শুয়া, ইয়াগুস, ইউক, নসর প্রভৃতি নামে অসংখ্য দেবদেবী ছিল। কলব গোত্র মানুষ আকৃতির ওয়াদ নামক মূর্তির পূজা করত। হামাদান গোত্র নারী মূর্তি শুয়ার পূজা করত। মাজহিদ গোত্র সিংহ মূর্তি ইয়াওস এর পুজা করত। এছাড়া মুরাদ গোত্র অশ্বাকৃতির ইউক এবং হিমইয়ারী গোত্র শকুনের মূর্তি নসর-এর পূজা করত। কুরআনে আরো যে দু’টি দেবতার নাম উল্লেখ আছে। তা হলো, আল জীব এবং আল তাগুত।

কা’বা গৃহে প্রতিমাঃ তৎকালীন আরবদের ধর্মীয় কুসংস্কার এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল যে, বর্বর আরবরা পবিত্র কা’বা গৃহে লাত, মানাত, উযযা, হোবলসহ ৩৬০টি প্রস্তর মূর্তি স্থাপন করেছিল। হোবল ছিল এদের মধ্যে সর্বপ্রধান। এদের অধিকাংশই ছিল নারী আকৃতির। এসব দেবদেবীকে তারা আল্লাহর কন্যারূপে কল্পনা করত।


নবীদের প্রতিকৃতিঃ অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন, জাহেলী আরবের লোকেরা মূর্তিপূজার পাশাপাশি কয়েকজন নবীর প্রতিকৃতি তৈরি করে পূজা করত। তারা হযরত ইবরাহীম (আ), হজরত ইসমাঈল (আ), হজরত ঈসা (আ) ও হজরত মারইয়াম (আ) প্রমুখের মূর্তি কা’বা ঘরে স্থাপন করেছিল।

বিভিন্ন ধর্মীয় কুসংস্কারঃ জাহেলিয়া যুগে আরব সমাজ মূর্তিপূজার পাশাপাশি বিভিন্ন কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। পুরোহিততন্ত্র, জীবজন্তু ও মানুষ বলিদান, তন্ত্রমন্ত্র, জাদুটোনা, জিন-পরী, ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস প্রভৃতি কুসংস্কার ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

হজ্জ পালনঃ জাহেলিয়া যুগে আরব সমাজে কা’বা গৃহে হজ্জ পালন পুণ্যময় কাজ বলে বিবেচিত হতো। হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে কা’বা ঘরে আগতদের একাংশ বেহায়াপনায় এত চরমে উঠেছিল যে, নারী পুরুষ উলঙ্গ হয়ে কা’বার চারদিকে তাওয়াফ করত।

সৌরজগতের পূজাঃ উন্মুক্ত মরু প্রান্তরে বসবাসকারী বেদুইনরা সৌর জগতের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্র প্রভৃতিকে প্রভুজ্ঞান করে পূজা করত।

জড়বাদীঃ আরব বেদুইনদের মধ্যে জড় পূজার উন্মেষ দেখা দেয়। এর কারণ ছিল, তারা কৃষিকাজে মরুভূমিতে স্থাপিত বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা করত। বেদুইনরা জড়বাদী বিশ্বাসের ফলে বৃক্ষ, কূপ, প্রস্তর ও গুহাকে পবিত্র মনে করত। এ জড়বস্তুগুলোকে তারা দেবদেবী ও পূজার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত।


দাহরিয়াঃ কিছু সংখ্যক লোক ছিল, যারা দেবদেবীর পূজার্চনা করত না, কোনো ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস করত না। জন্ম-মৃত্যু, বিপদ-আপদ, সুখ-দুঃখ, সবকিছুই প্রাকৃতিক নিয়মে হচ্ছে বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। এদেরকে দাহরিয়া বলা হতো। দাহরিয়া সম্প্রদায় পরকালীন জীবনকে অস্বীকার করত। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, আরবের অধিকাংশ লোকই পরকালীন জীবন তথা কেয়ামত, হাশর, বেহেশত, দোযখ ইত্যাদিতে অবিশ্বাসী ছিল।

হানিফ সম্প্রদায়ঃ বহুল প্রচলিত পৌত্তলিকতার মাঝেও আরবে কিছু সংখ্যক লোক ছিল আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী। তারা কোনো প্রকারের মূর্তিপূজায় অংশ গ্রহণ করত না। আরব সমাজে এরা হানিফ সম্প্রদায় নামে পরিচিত ছিল। ওরাকা বিন নওফল, আবু বকর, কবি যুহাইর প্রমুখ এ দলের অন্তভুক্ত।

ইহুদি ধর্মঃ প্রাক-ইসলাম যুগে ইহুদিরা নিজেদের ‘আহলে কিতাব’ বলে দাবি করত। অথচ তাদের সামগ্রিক ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল শিরক এবং মুনাফেকীতে ভরপুর। তারা হযরত ওযায়ের (আ) কে আল্লাহর পুত্র বলে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করত।

খ্রিস্ট ধর্মঃ জাহেলী যুগে ধর্মভ্রষ্ট খ্রিস্টানরা ত্রিত্ববাদের অনুসারী হয়ে পড়ে। তাদের বিশ্বাস ছিল- God the father, God the mother and God the son.

উপসংহারঃ একথা সুস্পষ্ট যে, প্রাক-ইসলাম যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল বিভিন্ন অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি ও বিশৃখলায় পরিপূর্ণ। মহানবী (স)-এর আবির্ভাবে নীতি নৈতিকতাহীন আরব সমাজ ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সুষ্ঠু সমাজ সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক