ধর্ম ও যাদুবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর



প্রশ্নঃ ধর্ম ও যাদুবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
অথবা, উদাহরণসহ যাদুবিদ্যা ও ধর্মের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর।

ভূমিকাঃ ধর্মের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কেননা বিভিন্ন জন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন। ধর্মের সাথে মানুষের আবেগ, অনুভূতি, ভক্তি-শ্রদ্ধা, ইবাদত ইত্যাদির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। অনেকে যাদুবিদ্যাকে ধর্মের অনুরূপ বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ধর্মের সাথে যাদুবিদ্যার পার্থক্য দিন ও রাতের পার্থক্যের মতো ব্যপক।

ধর্ম ও যাদুবিদ্যার পার্থক্যঃ সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীগণ ধর্ম শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। অতিপ্রাকৃত শক্তি, আত্মা ও বস্তুহীন শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে ধর্মীয় চেতনার জন্ম হয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে রয়েছে বিস্ময়, আবেগ-অনুভূতি, ভক্তি, শ্রদ্ধা ইত্যাদি। ধর্মীয় প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষ নিরাকার প্রভুর কাছে আকুতি-মিনতি করে থাকে। ধর্মীয় অনুভূতির মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে একাত্মতা স্থাপন করে।


ই. বি. টেলর তাই ধর্মকে অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে ধর্মের উৎপত্তির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নৃ-বিজ্ঞানী ফ্রেজার যাদুবিদ্যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, যাদুবিদ্যা ধর্মের আগে এসেছে, তা ক্রমে ক্রমে ব্যর্থ হলে ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে।

নৃ-বিজ্ঞানী ফ্রেজার তার The Golden Bough গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সংক্ষেপে যাদুবিদ্যা হলো প্রাকৃতিক কানুনের একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা এবং সেই সাথে একটা ভ্রান্ত পথ নির্দেশ, যা একটি মেকি বিজ্ঞান, সেই সাথে একটি ব্যর্থ কলা। ধর্ম ও যাদুবিদ্যার পার্থক্য নিম্নে তুলে ধরা হলো-


ধর্মঃ            (১) ধর্ম হচ্ছে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস।
যাদুবিদ্যাঃ (১) যাদুবিদ্যা হচ্ছে এমন একটা কৌশল যার দ্বারা লৌকিক ঘটনাগুলোকে বিভিন্নভাবে মোকাবেলা করা যায়।

ধর্মঃ           (২) কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় না।
যাদুবিদ্যাঃ (২) কিন্তু যাদুবিদ্যাকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়।

ধর্মঃ         (৩) ধর্মের বিধানে অতীন্দ্রিয় শক্তিকে বশে আনার জন্য কোনো ইন্দ্রজাল সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো হয় না।
যাদুবিদ্যাঃ (৩) কিন্তু যাদুবিদ্যায় অতীন্দ্রিয় শক্তিকে বশে আনার জন্য ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করা হয়।

ধর্মঃ           (৪) ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে মহাশক্তির সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ লাভ।
যাদুবিদ্যাঃ (৪) আর যাদুবিদ্যার উদ্দেশ্য মহাশক্তিকে তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করা।

ধর্মঃ           (৫) ধর্ম মহাশক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করে তার প্রার্থনা করে।
যাদুবিদ্যাঃ (৫) কিন্তু যাদুবিদ্যা মন্ত্র বলে মোহবিস্তার করে অথবা তোষামোদ আরোপ করে মহাশক্তিকে বাধ্য করতে চায়।

ধর্মঃ          (৬) ধর্ম সবার জন্য উন্মুক্ত, এতে আছে আনুষ্ঠানিকতা ও প্রচার কেন্দ্রিকতা।
যাদুবিদ্যাঃ (৬) যাদুবিদ্যা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়, ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠি বিশেষ এর প্রয়োগ শিখতে পারে।

ধর্মঃ           (৭) ধর্মের লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক, মানবিক ও কল্যাণমুখী।
যাদুবিদ্যাঃ (৭) কিন্তু যাদুবিদ্যার লক্ষ্য হচ্ছে কৌশলে উদ্দেশ্যসাধন করা ।

ধর্মঃ          (৮) ধর্মে আছে ভয়-ভীতি, বিশ্বাস, অনুনয়-বিনয়, প্রার্থনা ইত্যাদি।
যাদুবিদ্যাঃ (৮) কিন্তু যাদুবিদ্যায় আছে ঔদ্ধত্য, শক্তি প্রয়োগ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব।

ধর্মঃ           (৯) ধর্ম প্রার্থনায় বিশ্বাসী।
যাদুবিদ্যাঃ (৯) যাদুবিদ্যা অলৌকিক শক্তিকে হাতের মুঠোয় এনে, সে শক্তি দিয়ে অন্য শক্তিকে বশীভূত করতে প্রয়াসী হয়।

ধর্মঃ           (১০) ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য মানব কল্যাণকর, মহৎ ও পবিত্র।
যাদুবিদ্যাঃ (১০) যাদুবিদ্যা তন্ত্র- মন্ত্র, ভেলকিবাজি ও বিধি-নিষেধের বৈচিত্রতায় ভরপুর।

ধর্মঃ          (১১) ধর্মে কখনও সে তার নিয়তিকে চালনা করতে চায় না; বরং নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণই হচ্ছে তার প্রধান কর্ম।
যাদুবিদ্যাঃ (১১) যাদুবিদ্যায় বিশ্বাস হচ্ছে, সে তার নিয়তিকে চালনা করতে পারে, ফলে সে জীবনের প্রতি অধিকতর দৃঢ়তাব্যঞ্জক এবং সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে।

ধর্মঃ           (১২) ধর্ম হচ্ছে Humanization of-natural laws.
যাদুবিদ্যাঃ (১২) অন্যদিকে যাদুবিদ্যা হচ্ছে Naturalization of human actions.

ধর্মঃ           (১৩) ধর্ম এক অতীন্দ্রিয় অপরিবর্তনীয় জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে মানুষের নিরাপত্তা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
যাদুবিদ্যাঃ (১৩) অন্যদিকে যাদুবিদ্যা বিভিন্ন রকমের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে। এ যাদুবিদ্যা অবশ্যই শত্রুকে আঘাত হানার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে উল্লেখ্য, গবেষকগণ যাদুবিদ্যার সাথে ধর্মের সাদৃশ্য চিন্তা করে একথা বলেছেন যে, যাদুবিদ্যার ব্যর্থতার ফলেই ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে। কিন্তু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, সৃষ্টির শুরু থেকেই ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে। আর ধর্ম স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক