জাহেলি যুগে আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ জাহেলিয়া যুগের সাংস্কৃতিক অবস্থার বিবরণ দাও।
অথবা, জাহেলি যুগে আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গোটা বিশ্ব রাজনৈতিক অনাচার, অরাজকতা, হানাহানি ও বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত ছিল। তবুও এ সময়ে আরবদের সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নিম্নে জাহেলিয়া যুগে আরবদের সাংস্কৃতিক অবস্থা আলোচনা করা হলো।

জাহেলিয়া যুগে আরবদের সাংস্কৃতিক অবস্থাঃ Culture is the mirror of a nation. অর্থাৎ, সংস্কৃতি হলো একটি জাতির সমাজ জীবনের দর্পণ। জাহেলিয়া যুগে আরবদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা আদিম ধরণের থাকলেও তাদের সাংস্কৃতিক অবস্থা ছিল যথেষ্ট উন্নত এবং ব্যাপক প্রসারিত। যেমন-

(১) সৃজনশীল ক্ষমতাঃ প্রাক ইসলামী যুগে আরবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি অথবা সুরুচিপূর্ণ ও মার্জিত জীবনধার গড়ে ওঠেনি। মক্কা, মদিনা ও তায়েফের কয়েকটি বর্ধিষ্ণু শহরের বাসিন্দা ব্যতীত আরবের অধিকাংশ লোকই ছিল মূর্খ ও নিরক্ষর। তা সত্ত্বেও তাদের অসাধারণ সৃজনশীল শক্তির প্রভাবে নানা লোকগাঁথা, প্রবাদ ও লোকশ্রুতি সংরক্ষিত হয়েছিল। প্রখর স্মৃতিশক্তি ও অপূর্ব বাগ্মীতার জন্য তারা ইতিহাসে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।


(২) গীতিকাব্য ও সাহিত্য চর্চাঃ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রাক ইসলামী আরবগণ আধুনিক যুগের ন্যায় উন্নত, মার্জিত ও সুরুচিপূর্ণ না হলেও তারা এ কার্যকলাপ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। গীতিকাব্য রচনা ও সাহিত্য চর্চায় আরবদের অসাধারণ সৃজনশীল মেধাশক্তির পরিচয় মেলে। ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, সম্ভবত পৃথিবীতে অন্য কোনো জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্যচর্চায় এত স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

(৩) গীতিকাব্য ও সাহিত্যের বিষয়বস্তুঃ জাহেলিয়া যুগে আরব কবিদের কবিতায় সাবলীল গতি ও স্বচ্ছ বাক্য বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাদের বিষয়বস্তু রুচিসম্মত ছিল না। তাদের কবিতার বিষয়বস্তু ছিল প্রধানত প্রেমচর্চা, মদ, জুয়া, নারীদেহ, বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বিবরণ, যুগের বর্ণনা, উটের বিস্ময়কর গুণাবলি, ব্যঙ্গোক্তি প্রভৃতি।

(৪) গদ্য রচনাঃ লিখন পদ্ধতির বিকাশের অভাবে জাহেলিয়া যুগে আরবের গদ্য সাহিত্য তেমন সমৃদ্ধি লাভ করেনি। তবে বংশ বৃত্তান্ত, গোত্রীয় কলহের ইতিহাস ও যুদ্ধের বীরত্ব সংবলিত কিছু গদ্য সাহিত্য তারা রচনা করেছিল।


(৫) কাব্যপ্রীতিঃ ভাষাচর্চা, কবিতা রচনা ও সাহিত্যে তৎকালীন আরবদের বিশেষ প্রতিভা ছিল। নারী-পুরুষ সকলেরই প্রবল ভাষাপ্রীতি ও কাব্যপ্রীতি ছিল। ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, কাব্যপ্রীতিই ছিল আরব বেদুইনদের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক সম্পদ।

(৬) কাসিদাঃ আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী আরবি কাসিদা সমসাময়িক কালের ইতিহাসে অতুলনীয়। কাসিদাই ছিল তাদের একমাত্র উৎকৃষ্ট কাব্যরীতি।

(৭) উকায় মেলাঃ ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে আরবদের সাংস্কৃতিক জীবনে উকায মেলা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বের দাবিদার। প্রতিবছরই এ মেলা অনুষ্ঠিত হতো এবং সেখানে কাব্য প্রতিযোগিতা চলত। এর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ কবি ও কবিতা নির্বাচন করা হতো এবং পুরস্কৃত করা হতো শ্রেষ্ঠ কবিদের। এ মেলাকে ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি Academic Francaise of Arab's বলে অভিহিত করেছেন।

(৮) প্রবাদ প্রবচনঃ জাহেলিয়া যুগের আরবরা প্রবাদ প্রবচন রচনায়ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। লিখিত প্রবাদ প্রবচন তেমন একটা পরিলক্ষিত না হলেও লোক মুখে অনেক প্রবাদ প্রচলিত ছিল।

(৯) সাব’আ মুয়াল্লাকাঃ প্রাক ইসলাম যুগের সাহিত্যাঙ্গনে আরব কবিদের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের অনবদ্য সৃষ্টি ‘সাব’আ মুয়াল্লাকা'র মাধ্যমে। ঐতিহাসিকগণ একে Public Register of the Arabs বলে অভিহিত করেছেন।


(১০) গাঁথাগ্রন্থঃ মুআল্লাকাত ছাড়াও জাহেলি যুগে অসংখ্য বীরত্ব গাঁথা সাহিত্য, কাব্য ও গ্রন্থ প্রণীত হয়। এর মধ্যে দিওয়ান আল হামাসা, আল মুফাজ্জালিয়াত ও কিতাব আল আগানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(১১) জাহেলিয়া যুগের উল্লেখযোগ্য কবিগণঃ প্রাক ইসলাম যুগের উল্লেখযোগ্য আরব কবিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইমরুল কায়স, হারেস, লাবিদ, আমর, ওয়ারাকা, উম্মে কুলসুম, আনতারা প্রমুখ। জাহেলিয়া যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ইমরুল কায়সকে বলা হয় Shakespeare of the Arab.

(১২) স্থাপত্য কলা, শিলালিপি ও মুদ্রাঃ প্রাক ইসলামী যুগে আরব দেশের উত্তর ও দক্ষিণাংশের কতিপয় সমৃদ্ধশালী রাজ্যে স্থাপত্যশৈলীর চরম নিদর্শন বিদ্যমান ছিল। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বিভিন্ন শিলালিপি, স্বর্ণ ও রৌপ্যের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐতিহাসিক মাসুদা বলেন, আরবের যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকেই অনেক মনোরম অট্টালিকা, ছায়াদানকারী বৃক্ষ ও প্রবহমান ঝর্ণাধারা দেখা যায়।

(১৩) প্রশংসনীয় গুনাবলিঃ প্রাক ইসলামী যুগের অধিবাসীদের অকাট মূর্খ, বর্বর, অজ্ঞ ও নিরক্ষর বলা যায় না। এ সময়ের আরবের গোত্রপ্রীতি, আতিথেয়তা, সরলতা, কাব্যানুরাগ, বদান্যতা, বীরত্ব, স্বাধীনপ্রিয়তা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রতা, স্মৃতিশক্তি- তাদের চরিত্রের প্রশংসনীয় ও বিরল গুণাবলির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

উপসংহারঃ প্রাক ইসলামি যুগে আরবদের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল চরম হতাশাজনক। তবে তাদের Cultural life তথা সাংস্কৃতিক জীবন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় উন্নত ছিল। যদিও তা ছিল ব্যাপক পাপ-পঙ্কিলতায় ভরপুর। কিন্তু মুহাম্মদ (সা) এর আগমনের পর জাহেলি যুগের অনেক কবি সাহিত্যিক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং উত্তম সাহিত্য রচনা করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক