প্রশ্নঃ মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে টমাস হবস ও জন লকের ধারণা আলোচনা কর।
অথবা, মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে টমাস হবস ও জন লকের ধারণা তুলনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে টমাস হবস এবং জন লক এক বিশিষ্ট আসন অধিকার করে আছেন। মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে উভয় চিন্তাবিদই স্ব-স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের মতবাদ প্রদান করেছেন। তাদের মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই পরিলক্ষিত হয়। তবে হবস এবং লক উভয়ই রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ একই প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত বলে অভিমত পোষণ করেন। হবস এবং লক মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন নিম্নে তা আলোচনা করা হল-
অথবা, মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে টমাস হবস ও জন লকের ধারণা তুলনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে টমাস হবস এবং জন লক এক বিশিষ্ট আসন অধিকার করে আছেন। মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে উভয় চিন্তাবিদই স্ব-স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের মতবাদ প্রদান করেছেন। তাদের মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই পরিলক্ষিত হয়। তবে হবস এবং লক উভয়ই রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ একই প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত বলে অভিমত পোষণ করেন। হবস এবং লক মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন নিম্নে তা আলোচনা করা হল-
টমাস হবসঃ সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলকারী টমাস হবস ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে তার ধারণা ছিল নিম্নরূপঃ
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে হবসের ধারণাঃ হবস তার ‘লেভিয়াথান' গ্রন্থে সামাজিক চুক্তির আলোচনায় মানব প্রকৃতি সম্পর্কে বলেন, ‘মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক'। মানুষকে তিনি জড় বস্তুর মত একটি আবেগহীন যন্ত্র বিশেষ বলে বর্ণনা করেছেন। হবস মানব প্রকৃতির যে সকল বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন তার মধ্যে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
(১) মানুষ মূলত জড় পদার্থঃ হবসের মতে, মানুষ মূলত একটি জড় পদার্থ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জড় বস্তুর ন্যায় সে কার্যকারণ সম্পর্কিত রীতির নিয়ন্ত্রনাধীন।
(২) আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণার দ্বারা চালিতঃ তিনি বলেন, মানুষের যাবতীয় কর্মপ্রচেষ্টা ও যাবতীয় আবেগ অনুভূতি আকর্ষণ ও বিকর্ষণজনিত আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণার দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।
(৩) ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষাঃ হবসের মতে, ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত ও মজ্জাগত। তিনি বলেন, মানুষ যদিও আকাক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয় কিন্তু সে তার আকাঙ্ক্ষাকে শুধু বর্তমানের সুখান্বেষণে সীমাবদ্ধ রাখেনা বরং ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগায়।
(৪) মানুষ স্বাতন্ত্র্যবাদীঃ হবসের মতে মানুষ স্বাতন্ত্র্যবাদী। অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হওয়াকে মানুষ পছন্দ করেনা। প্রত্যেক মানুষ নিজস্ব-ধ্যান-ধারণা দ্বারা পরিচালিত। প্রতিটি ব্যক্তি একটি স্বাতন্ত্র্য অবস্থান রক্ষা করে চলেছে। একজনের সঙ্গে অন্য জনের কোন মিল নেই।
(৫) সকল মানুষই প্রায় সমানঃ হবস মনে করেন যে, মানুষে মানুষে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আপাতদৃষ্টিতে পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলেও মানুষ একে অপরের প্রায় সমান। কেননা দৈহিক দিক থেকে কেহ শক্তিশালী হলেও জ্ঞানের দিক থেকে দুর্বল হতে পারে। আবার অন্য ব্যক্তি এর বিপরীত হতে পারে। এক্ষেত্রে বলা যায় মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে হবসের মূল কথা হলো মানুষ স্বভাবতঃ স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও পরশ্রীকাতর।
হবসের মতে প্রকৃতির রাজ্যঃ হবসের মতে রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। প্রকৃতির রাজ্যে ছিল ভয়াবহ ও দুর্বিসহ। সেখানে মানুষে মানুষে সর্বদা বিবাদ লেগেই থাকত। কেননা প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্থ থাকত। ‘জোর যার মুল্লুক তার' এই ছিল প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থা। সেখানে কোনো সরকার ছিল না বিধায়, কোন আইনও ছিলনা। এরূপ অবস্থায় মানুষ সর্বদাই ভয়-ভীতি ও মৃত্যুর ভয়ে দিনাতিপাত করত। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ ছিল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও পরশ্রীকাতর। আর মানুষের জীবন ছিল সঙ্গীহীন, অসহায়, নোংরা, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী। হবস প্রকৃতির রাজ্যে মানুষে মানুষে বিবাদের তিনটি কারণের কথা বলেছেন। যথাঃ (১) অন্যের সব কিছু আত্মসাৎ করার প্রবণতা (২) নিজের কোনো কিছু অন্যকে না দেয়ার প্রবণতা এবং (৩) সম্মান ও গৌরব অর্জনের প্রবণতা। (৪) সমাজবিহীন অবস্থা (৫) মুখোমুখি লড়াই (৬) ন্যায়-অন্যায়ের স্থান ছিল না (৭) যুক্তির প্রাধান্য এবং (৮) প্ৰাকৃত আইন।
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে জন লকের ধারণাঃ লক তার ‘টুট্রীটিজেসের' মধ্যে আলাদাভাবে মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা না করলেও তার গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় এ সম্পর্কে বিক্ষিপ্ত আকারে যে সব তথ্য বিধৃত হয়েছে সেগুলোকে একত্র করলে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে নিম্নরূপ বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়-
প্রথমতঃ মানুষ যুক্তিবাদী ও শান্তিপ্রিয়। লক মনে করতেন যে, মানুষের মধ্যে লোভ ও লালসার উপাদান রয়েছে। তবে মানুষ যুক্তির দ্বারা সেসব কু-প্রবৃত্তি গুলোকে দমন করে রাখে। তার মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ প্রাকৃতিক আইন মেনে চলত এবং শান্তির অন্বেষায় প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা পরিচালিত হতো। তিনি বলেন যে, ‘মানুষ শুধু যুক্তিবাদী নয় বরং নৈতিক প্রাণীও বটে।'
দ্বিতীয়তঃ লকের মতে, মানুষ স্বভাবত সমান। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে হয়ত কেউ বেশি জ্ঞানী কেউ কম জ্ঞানী, কেউ সবল কেউ দূর্বল, কিন্তু এসব পার্থক্য তাদের সাদৃশ্যের তুলনায় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তাছাড়া, তিনি বেশ নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বাস করেন যে, মানুষের এসব বৈপরীত্যের অধিকাংশই কৃত্রিম অর্থাৎ মানুষের নিজের হাতে তৈরি। তার মতে প্রত্যেকটি শিশু সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার মন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। পরে সে যেরকম পরিবেশের মধ্যে লালিত-পালিত হয় ঠিক সে পরিবেশ অনুসারে তার চরিত্র ও মানসিকতা গড়ে ওঠে।
প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে লকের অভিমতঃ লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল শান্তি, সহযোগিতা ও সম্প্রীতির এক সুখময় স্থান। যেহেতু মানুষ শান্তি প্রিয় ও যুক্তিবাদী ছিল এবং প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা চালিত হত সেহেতু প্রকৃতির রাজ্য ছিল শুভেচ্ছা ও প্রতিরক্ষার রাজ্য। কিন্তু এ সমস্ত সুবিধা সত্ত্বেও কতকগুলো অসুবিধা ছিল যার ফলে প্রকৃতির রাজ্যে স্বাচ্ছন্দ্য গতি ব্যাহত হয়ে পড়েছিল। এগুলো হলো- পক্ষপাতদুষ্ট বিচার, বিচারকের নির্দেশ বা আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং একই বিষয়ের ওপর নানা ধরনের আইন বা সিদ্ধান্ত। এ সকল অসুবিধা হতে রেহাই পাবার জন্য প্রকৃতির রাজ্যে জনগণ নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে বলে লক মত ব্যক্ত করেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে হবস ও লকের মতবাদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ একই প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত বলে উভয়ই অভিমত পোষণ করেন। তারা দু'জনই প্রাকৃতিক পরিবেশের এক অসহনীয় জীবনযাত্রা হতে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে মানুষ সংগবদ্ধ ভাবে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন বলে অভিমত পোষণ করেন। তবে হবস প্রাকৃতিক পরিবেশকে স্বার্থপর, কলহপূর্ণ মানুষের সাথে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের বলে চিহ্নিত করেছেন। অপর দিকে লক প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতো বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ