জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আধুনিক দার্শনিকদের মতবাদ ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আধুনিক দার্শনিকদের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জড়ের প্রকৃতি সম্বন্ধে আধুনিক এবং অত্যাধুনিককালের দার্শনিকদের মতবাদ ব্যক্ত কর।

ভূমিকাঃ তত্ত্ববিদ্যা বা সত্তা সম্পর্কীয় দর্শনে বিশ্বজগতের আদি উপাদান বা সত্তার স্বরূপ সম্পর্কে যে আলােচনা করা হয় তাতে দেখা যায় যে, সত্তা বা বাস্তব সত্তার স্বরূপ দু'ধরনের হতে পারে- জড় বা বস্তু এবং মন বা আধ্যাত্মিক শক্তি। জড় বা বস্তুকে ভিত্তি করে জড়বাদ বা বস্তুবাদ এবং মন বা আত্মাকে ভিত্তি করে ভাববাদ গড়ে ওঠে।

জড়ের প্রকৃতিঃ সাধারণ লােক দেশ ও কালস্থিত এবং যা প্রত্যক্ষিত হয় সবকিছুকে জড় বলে মনে করে। তাদের মতে, জড় হলাে বস্তুর নিয়ত পরিবর্তনের মাঝে অপরিবর্তনীয়তা। কিন্তু এ অপরিবর্তনীয়তার স্বরূপ কী এবং জাগতিক বস্তুর সাথে এর সম্পর্কের কোনাে সুষ্ঠু জবাব সাধারণ লােক দিতে পারে না। তাই আমরা দার্শনিক মতবাদগুলাে আলােচনা করব।

জড়ের প্রকৃতি নির্ধারণের প্রাচীন দর্শনঃ দর্শনের প্রাচীনযুগের দার্শনিক থেলিস প্রথম বললেন- পানিই আদিসত্তা। এরপর এনাক্সিম্যান্ডার বললেন, অসীমই সত্তা। এনাক্সিমিনিস বললেন, বায়ুই আদিসত্তা। হিরাক্লিটাস বললেন, আগুনই আদিসত্তা। এরপর এম্পিডক্লিস বললেন, আগুন, পানি, বায়ু, মাটি-এ চারটি বস্তু আদিসত্তা। ডেমােক্রিটাস ও লিউসিপাম বললেন পরমাণুর কথা।

জড়ের প্রকৃতি নির্ধারণে আধুনিক দর্শনঃ আধুনিক দর্শনে বুদ্ধিবাদী ডেকার্ট জড়ের প্রকৃতি নিয়ে আলােচনা করেছেন। ডেকার্টের মতে, জগতে দু'টি দ্রব্য আছে- জড় ও মন। জড় মনের ঠিক বিপরীত তত্ত্ব। জড় ও বিস্তৃতি সমার্থক, মনের বিস্তৃতি নেই। জড়ের কোনাে চেতনা নেই। জড়ের গতির কারণ হিসেবে তিনি ঈশ্বরকে টেনে আনেন। স্পিনােজা মন ও জড়কে গুণের পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এগুলাে একমাত্র নিরপেক্ষ দ্রব্য অসীমের গুণ মাত্র। লাইবনিজের মতে, মােনাডই দ্রব্য। এই মােনাডের চেতনা আছে।

আধুনিক মতবাদঃ জড়ের প্রকৃতি নির্ধারণে আধুনিক মতবাদে আধুনিক দার্শনিকদের মতবাদ এবং অত্যাধুনিক দার্শনিকদের মত পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আধুনিক ও অত্যাধুনিক দার্শনিকের মতবাদ বর্ণনা করা হলাে-

আধুনিক দার্শনিকদের মতবাদঃ নিম্নে আধুনিক দার্শনিকদের জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরা হলাে-

ডেকার্টঃ আধুনিক দর্শনে বুদ্ধিবাদের জনক ডেকার্ট জড়ের প্রকৃতি নিয়ে প্রথম আলােচনা করেন। তার মতে, জগতে দুটি দ্রব্য আছে- জড় ও মন। জড় মনের ঠিক বিপরীত তত্ত্ব। জড় এবং বিস্তৃতি হলাে সমার্থক। মনের বিস্তৃতি নেই। আবার মন ও চৈতন্য সমার্থক। জড়ের কোনাে চৈতন্য নেই। জড় ও মন পরস্পর নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা। তিনি জড়ের বিস্তারকে তার মুখ্য গুণ এবং রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ প্রভৃতিকে জড়ের গৌণ গুণ বলে অভিহিত করেছেন। বিস্তৃতির অর্থ ছড়িয়ে থাকা। গতি সম্পূর্ণ পৃথক নিয়ম। তা-ই যদি হয়, জড়ের গতি কীভাবে নিরূপণ করা যাবে? এ প্রশ্নের ভিত্তিতে ডেকার্ট ঈশ্বরকে গতির কারণ বলেছেন।

লকঃ বিখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক লকের মতে, জড় বা বস্তু হলাে কতগুলাে গুণের আধার। তার মতে, আমরা বস্তকে প্রত্যক্ষ করতে পারি না বরং বস্তুর গুণাবলিকেই শুধু প্রত্যক্ষ করতে পারি। লকের মতে, বস্তুর গুণ দুই প্রকার- মুখ্য ও গৌণ। মুখ্য গুণ হলাে বিস্তৃতি, ঘনত্ব, গতি ইত্যাদি এবং এগুলাে বস্তুনির্ভরশীল। গৌণ গুণ হলাে রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ইত্যাদি এবং এগুলাে মননির্ভর। বস্তুর এ গুণগুলাে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থাকে না এবং এ গুণগুলাের অস্তিত্বের জন্য একটি আধার আছে। এ আধারই জড় বা বস্তু। এ আধার যদিও অজ্ঞাত, তথাপি একে অস্বীকার করা যায় না।

বার্কলিঃ বার্কলি লকের মতবাদের সমালােচনা করে বলেছেন, জড় বা বস্তু যদি অজ্ঞাত হয় তাহলে তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা অযৌক্তিক। বস্তুর গুণকেই আমরা দেখি। গুণের আধার রূপে কোনাে কিছু পাই না। যা পাই না বা দেখা যায় তার অস্তিত্ব স্বীকার করার কোনাে যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তা ছাড়া তিনি জড়ের মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের পার্থক্য স্বীকার করেন না। সবগুলােই এক ধরনের এবং উভয়বিধ গুণের জ্ঞান প্রত্যক্ষকারী মনের উপর নির্ভরশীল। তাই আসলে সব গুণই মনের ধারণা মাত্র। অতএব তার মতে, জড় আসলে মনের কতগুলাে ধারণার সমষ্টিমাত্র। বার্কলির এ মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে জড়ের নির্জড়ীকরণ তত্ত্ব নামে পরিচিত।

মিল ও হিউমঃ মিল ও হিউম জড়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না। কারণ, জড়ের অস্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। অভিজ্ঞতায় যে বস্তুকে পাওয়া যায়, শুধু তারই অস্তিত্বকে স্বীকার করা যায়। আর যা পাওয়া যায় না, তার অস্তিত্ব স্বীকার করা অযৌক্তিক। তাই জড় বলে কোনাে পৃথক দ্রব্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বরং জড় বস্তু আসলে সংবেদনের সমষ্টি মাত্র।

কান্ট (Kant): দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মতে, বহির্জগতে জড়ীয় কিছু নেই। বস্তুজগৎ একদিকে হলাে বস্তুরূপ, অন্যদিকে সংবেদনের আকার এবং জ্ঞানের মৌলিক ও অপরিহার্য ধারণা দ্বারা সৃষ্ট।

অত্যাধুনিককালের দার্শনিকদের মতবাদঃ জড়ের প্রতি সম্পর্কে অত্যাধুনিক দার্শনিকগণ যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা নিম্নরূপ-

আলেকজান্ডারঃ অধ্যাপক আলেকজান্ডারের মতে, জগতের আদিম উপাদান হলাে দেশ-কাল। জড়ের উৎপত্তি এ দেশ-কাল থেকে। জড় হলাে দেশ-কাল উপাদান থেকে পরবর্তীকালের উন্মেষের ফল। দেশ-কাল আপেক্ষিকতা থেকে সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি হয়।

হােয়াইটহেডঃ হােয়াইটহেডের মতে, জড় হলাে যাকে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করি। জগৎ পরিবর্তনের মাঝে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। কিন্তু আমরা একে প্রথমত জানি সংবেদনের মধ্যে। তারপর ব্যাখ্যার ক্রমােন্নতির সাথে সাথে আমরা সেই জগৎকেই প্রত্যক্ষগত বস্তুর মাধ্যমে ভালােভাবে জানি। জড় অর্থে তিনি প্রকৃতিকে বুঝেন। এ সমালােচনা ও উপরিউক্ত আধুনিক ও অত্যাধুনিক দার্শনিকবৃন্দের মতবাদ বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে অনেক সালোচনা করা হয়েছে। ডেকার্ট যে মতবাদ দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। তিনি বলেছেন, মন হলাে চেতদ্রব্য আর দেহ হলাে বিস্তত দ্রব্য। কী করে চেতন ও বিস্তৃতির সম্পর্ক সম্ভব হয়েছে তা তিনি যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করেননি। লাইবনিজ বলেছেন, বিকাশের শেষ মাথায় গিয়ে আমরা ঈশ্বরকে পাই, যিনি সম্পূর্ণরূপে জড়হীন। তাই তার মতবাদ জড়বাদকে সম্পূর্ণভাবে নির্জড় করে তুলেছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে মতবাদগুলাে যথেষ্ট সমালােচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও দর্শনের ক্ষেত্রে এদের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে যেসব মতবাদ আলােচনা করেছি, সেগুলাে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে সমর্থিত হয়নি। কিন্তু জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে এ মতবাদগুলাে প্রথম এবং মােটামুটি গ্রহণযােগ্য মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। এ কারণে দর্শনের ইতিহাসে এদের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক