বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক ধারণাগুলাে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক ধারণাগুলাে আলােচনা কর।
অথবা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক ধারণাগুলাের বর্ণনা দাও।

ভূমিকাঃ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান পদ্ধতি মৌলিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত যে কোনাে প্রকারের গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা একমাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমেই সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যায়। কিংবা সত্যকে আবিষ্কার করা যায়। নিম্নে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে-

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কিছু মৌলিক ধারণাঃ ঘটনা, প্রকল্প, স্বীকৃতি, তত্ত্ব, বিধি ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত।

ঘটনা (Fact): ঘটনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রথম ও প্রধান আলােচ্য বিষয়। আমেরিকান College Dictionary উল্লেখ করেছে, ঘটনা হলাে "What is really happened."

ঘটনাকে Goode ও Hatt পর্যবেক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, “ঘটনা কেবল একটি দৈবিক পর্যবেক্ষণ নয়, বরঞ্চ তা কোনাে বিষয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিবৃতি। এ সমস্ত পর্যবেক্ষণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত জ্ঞানের সাথে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পর্কযুক্ত।”

P.V. Young ঘটনাকে তথ্যের (data) অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন, “একটি ঘটনার মধ্যে মূলত দুই বা ততােধিক বিষয়ের বা উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান থাকে।”

ধারণা (Concept): বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান হলাে ধারণা বা প্রত্যয়। C. Seltic এবং অন্যরা গবেষণায় ধারণার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, “অনুসন্ধানকারীদের যেকোনাে দল তাদের তথ্য সংগঠিত করতে চাইলে, যাতে তথ্যগুলাের মধ্যে সম্পর্ক অনুধাবিত হতে পারে সে জন্য অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রত্যয় ব্যবহার করে থাকেন। ধারণা একটি সম্পূর্ণ বিমূর্ত অবস্থা যা বাস্তবে কিছু উপাদানের ইঙ্গিত দান করে। কোনাে বিষয়কে ধারণা পদবাচ্য হতে হলে তাকে অবশ্যই যােগসূত্র স্থাপনক্ষম হতে হয়।

প্রকল্প (Hypothesis): প্রকল্প বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি অন্যতম হাতিয়ার। একে অনুসন্ধান কাজের দিক নির্দেশক বলা হয়ে থাকে। অনুসন্ধান কাজে গবেষককে কি দেখতে হবে প্রকল্প তা বলে দেয়। ঘটনা মধ্যকার একাধিক প্রত্যয় বা চলকের সম্পর্ক সম্বন্ধে নতুন কিছু জানার জন্য গবেষক প্রকল্প গঠন করেন এবং বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তা তত্ত্বে উন্নীত করতে চেষ্টা করেন।

Webster প্রকল্পের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছেন যে, “প্রকল্প হচ্ছে একটি ক্ষণস্থায়ি অনুমান যা এর যৌক্তিক কিংবা বাস্তবিক ফলাফল নির্ণয় বা পরীক্ষার জন্য প্রণীত হয়। বর্তমানে উপস্থিত প্রমাণসমূহের অপর্যাপ্ততার কারণে প্রকল্প একটি পরীক্ষাণাধীন ব্যাখ্যা।”

K.D. Baily সংজ্ঞাটি কিছুটা পরিমার্জিত করে বলেছেন, “প্রকল্প হলাে একটি অস্থায়ি ব্যাখ্যা যার পরীক্ষার প্রয়ােজনীয় প্রমাণ প্রচ্ছন্ন হলেও বর্তমান।”

অনুমান (Assumption): বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগের ক্ষেত্রে প্রকল্প গঠন যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তেমনি সম্ভাব্য কিছু বিষয়কে অনুমান হিসেবে ধরে নেয়া অনুসন্ধান কাজের জন্য যথেষ্ট সহায়ক বলে বিবেচিত। বিশ্লেষণাধীন বিষয়ের একটি নির্দিষ্ট দিকের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করাই হলাে প্রকল্প। আর এ ক্ষেত্রে একই বিষয় সম্পর্কিত কিছু কিছু দিক সংশ্লিষ্ট গবেষণায় সত্য বলে ধরে নেয়াই হলাে অনুমান। অনুমানের এ সত্যতা কেবল ঐ অনুসন্ধান কাজের ক্ষেত্রেই ধারণা করা হয়।

অনুমানের সংজ্ঞায় Lilian Ripple বলেন, “অনুমান হলাে কোনাে বিশেষ অনুসন্ধানের যেভাবে ব্যক্ত রয়েছে সেভাবেই গৃহিত কোনাে প্রস্তাবনা। “অনুমানকে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করে সাধারণত বিবেচনা করা যায়। যেমন- (১) মূল্যবােধ সম্পর্কিত অনুমান; (২) সাধারণ বৈশিষ্ট্যধারি চলক সম্পর্কিত অনুমান এবং (৩) বিশেষ অনুসন্ধানপ্রসূত চলক সম্বন্ধীয় অনুমান।

তত্ত্ব (Theory): তত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা ও মতামত প্রচলিত আছে। সনাতনী সমাজবিজ্ঞানীদের (এমিল ডুরখেইম, কার্ল মার্কস, ম্যাক্স ওয়েবার) দৃষ্টিতে তত্ত্ব হলাে অপরীক্ষণযােগ্য বিবৃতির সমষ্টি। বর্তমান সমাজ গবেষকগণ মনে করেন যে, নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর জড়ােকৃত ঘটনার সমষ্টি হলাে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। B.R. Buges Ki এর মতে, “একটি বিরাট সংখ্যক ঘটনা বা নিরীক্ষণকে বিবেচনার জন্যে সংগঠিত পরম্পর ক্রিয়াশীল সম্পর্কযুক্ত অথবা স্বতন্ত্র নীতির সমষ্টিই হলাে তত্ত্ব।”

চলক (Variable): সাধারণ কথায় যা পরিবর্তিত হয় তাই চলক। মূলত চলক এমন এক ধরনের গুণ, বৈশিষ্ট্য বা অবস্থা, যা এইক পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চলকের মূল্যমান পরিবর্তনশীল। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সবচেয়ে ক্ষুদ্র অথচ সর্বাধিক সংবেদনশীল উপাদান হচ্ছে চলক। Barry F. Anderson বলেছেন, "A variable is a set of mutually exclusive properties." অর্থাৎ চলক হলাে পরস্পর বিচ্ছিন্ন গুণের সমাবেশ। এখানে Property বলতে ঐ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, যা নির্দিষ্ট কিছু দিকের প্রতি ইঙ্গিত দান করে। যেমন-’ লাল’ একাট বৈশিষ্ট যা ‘কালাে’ বা ‘হলুদ' হতে আলাদা এবং যার কিছু নিজস্ব দিক রয়েছে। এ মতে চলক হলাে- পুরুষ-মহিলা, সাদা-কালাে, মােটা-পাতলা ইত্যাদি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জ্ঞান আহরণ করাই বিজ্ঞানের শেষ কথা নয়। বিজ্ঞান বরঞ্চ তার আহরিত জ্ঞানকে সুসংঘবদ্ধ করতে প্রয়াসী। বিজ্ঞানী কোনাে কিছু সম্পর্কে কোনাে নতুন তথ্য পেলে তা অনুরূপ ঘটনা সম্পর্কে সংগৃহিত তথ্যের সাথে সম্পর্কিত করতে চান। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় জ্ঞান আহরণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ সমস্ত জ্ঞানকে সসংঘবদ্ধ করা ও পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে সম্পকিত করা; কেননা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞান কোনাে কাজেই লাগে না। তাই সঙ্গত কারণেই ঘটনা, প্রকল্প, স্বীকৃতি, তত্ত্ব, বিধি ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক