বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্য দেখাও


প্রশ্নঃ বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
অথবা, বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যকার বৈসাদৃশ্য সংক্ষেপে উল্লেখ কর।

ভূমিকাঃ বাস্তববাদ এমন একটি সত্তাবিষয়ক মতবাদ, যে মতবাদ অনুসারে বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ বা মননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। জ্ঞাতা কোনাে জ্ঞেয় বস্তুকে না দেখলে তার কোনাে অস্তিত্ব থাকে না- এ কথা বলা আমাদের কোনাে যুক্তিসঙ্গত অধিকার নেই। জ্ঞাতা ছাড়াই জ্ঞেয় বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। যেমন-কলম্বাস আমেরিকা নামক দেশ আবিষ্কার করার পূর্বেও আমেরিকা নামক দেশের অস্তিত্ব ছিল। তবে নাম হয়তাে ছিল না।

বাস্তববাদের ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্যঃ বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে সেগুলাে তুলে ধরা হলাে-

(১) জ্ঞেয়বস্তুর স্বরূপঃ বাস্তববাদীরা জ্ঞেয় বস্তুর মননিরেপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাদের মতে, বস্তুর অস্তিত্ব মনের নিজস্ব কোনাে ভূমিকা নেই। কিন্তু নব্য বাস্তববাদীর মনে করেন যে, জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব মন নিরপেক্ষ হলেও এখানে মনের গুরুত্ব রয়েছে। মনের ধারণার সঙ্গে অবিকল বা অনুরূপ তা আছে।

(২) জ্ঞাতা সম্পর্কে পার্থক্যঃ জ্ঞাতা সম্পর্কে বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, জ্ঞাতা বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনাে প্রভাব ফেলতে পারে না। বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান। অপরদিকে, নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলে তা জ্ঞাতার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

(৩) জ্ঞানের বিষয় সম্পর্কেঃ জ্ঞানের বিষয় সম্পর্কে বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, বস্তুর জ্ঞান মননিরপেক্ষ। মন নিরপেক্ষভাবে বস্তুর অস্তিত্ব বিদ্যমান। কারাে জানার উপর বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে না। অপরদিকে নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, জ্ঞানীয় সম্পর্কে সঙ্গে মত আবদ্ধ, কিন্তু আমাদের জ্ঞানের বস্তুর স্বরূপ নির্ভর করে না। বস্তুর সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক হচ্ছে বহিঃসম্পর্ক।

(8) প্রত্যক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকেঃ প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে বাস্তববাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, বস্তুর অস্তিত্ব মন নিরপেক্ষ। ইন্দ্রিয় দ্বারা এসব বস্তুর সাক্ষাৎ পরিচয় মেলে। অনুভবের মাধ্যমে বস্তুর ধর্মকে জানা যায়। মনের ধারণার সাথে বস্তুর ধারণার সাদৃশ্য বিদ্যমান। অপরদিকে নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, বস্তুর সাথে আমাদের সম্পর্ক জ্ঞানীয়। জ্ঞানীয় সম্পর্কে আমরা বন্ধুর সাথে আবদ্ধ। আমাদের জ্ঞানের ওপর বস্তুর স্বরূপ নির্ভর করে না। প্রত্যক্ষণে প্রত্যক্ষণ কর্তা ও বস্তু থাকতেই হবে। বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক হলাে বহিঃসম্পর্ক। প্রত্যক্ষণের একটি স্বতন্ত্র বস্তু থাকতে হবে।

(৫) জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কঃ বাস্তববাদীদের মতে জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাতানির্ভর নয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞতা জ্ঞেয় বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে থাকে। আবার বিজ্ঞানসম্মত বাস্তববাদ বস্তুর সাক্ষাৎ অনুভব স্বীকার করেন না। তাদের মতে, বস্তুকে সাক্ষাতভাবে জানা যায়, তা হলাে বস্তুর প্রতিফলন। অপরদিকে নব্য বাস্তববাদীদের মতে, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক হলাে বাইরের সম্পর্ক। এ সম্বন্ধ স্থাপনে কারও কোনাে পরিবর্তন হয় না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও নব্য বাস্তববাদের বিভিন্ন সমালােচনা রয়েছে, তবুও এর বাস্তবমূল্য অপরিসীম। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এসে নব্য বাস্তববাদের উদ্ভব। এ মতবাদ হেগেলের ভাববাদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ। বর্তমান প্রগতির যুগে ভাববাদের প্রয়ােগ নেই বললেই চলে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নব্য বাস্তববাদ বস্তুবাদী চিন্তায় এক নবজাগরণের সূত্রপাত করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক