অথবা, লিখিত সংবিধানের সুবিধাসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, লিখিত সংবিধানের ইতিবাচক দিক আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে ভিন্ন ধরনের মতপার্থক্য থাকলেও সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্রেণিবিভাগ হলাে লিখিত ও অলিখিত সংবিধান। যখন একটি রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার মৌলিক নিয়মগুলাে এক বা একাধিক দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে তখণ তাকে লিখিত সংবিধান বলে। লিখিত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যাবশ্যক মূলনীতিগুলাে, সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকে। লিখিত সংবিধানের প্রকষ্ট উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। আর এ লিখিত সংবিধানে বহুবিধ গুণাবলি বিদ্যমান।
লিখিত সংবিধানের গুণাবলি (Merits of written constitution): লিখিত সংবিধানের কতকগুলাে বিশেষ গুণবাচক বৈশিষ্ট্য সহজেই দৃষ্টিগােচর হয়। এ লিখিত সংবিধানের গুণাবলির মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ উল্লেখযােগ্য।
১. সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টঃ লিখিত সংবিধান সাধারণত সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা বিশেষ বিচার বিবেচনা ও চিন্তাভাবনার পর লিখিত আকারে এ সংবিধানের সৃষ্টি হয়। শাসনতন্ত্রের বিধানসমূহ লিখিত, তাই সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট এবং সহজেই বােধগম্য হয়। এ কারণে লিখিত শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত কোন বিষয় সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সহজে কোনরকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় না।
২. স্থায়িত্বঃ স্থায়িত্ব লিখিত সংবিধানের আর একটি গুণবাচক বৈশিষ্ট্য। এ সংবিধানকে সরকার সহজে পরিবর্তন করতে পারে না। লিখিত সংবিধান সংশােধনের জন্য এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। তাই সরকারের খেয়াল খুশি এবং জনগণের তাৎক্ষণিক উন্মাদনার চাপের মুখেও লিখিত সংবিধান অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
৩. লিপিবদ্ধ থাকেঃ লিখিত সংবিধান কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ থাকে। তাই জনগণ পাঠে তাদের অধিকার এবং কর্তব্য, সরকারের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সরকার এবং জনগণ বা জনগণের মধ্যে কোন। প্রকার ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলে তা সংবিধান অনুশীলনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়। লিখিত হলে সহজে দ্বিমতের অবকাশ থাকে না। সংবিধান লিখিত আকারে থাকলে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়ােজনে সগ্রাম করতে পারে।
৪. মৌলিক অধিকার সুরক্ষণঃ লিখিত সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুস্পষ্ট ভাষায় লিপিবদ্ধ করা থাকে। এর ফলে নাগরিকদের প্রতি সরকারের কর্তব্য এবং নাগরিকগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত থাকে। তাছাড়া লিখিত সংবিধান নির্দিষ্ট ও স্থায়ী হওয়ার জন্য সরকার স্বৈরাচারী হয়ে জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
৫. বিচারকার্যের সুবিধাঃ অনেকের মতে, সংবিধান লিখিত হলে আদালতের পক্ষে বিচারকার্য সম্পাদন করতে সুবিধা হয়। কারণ এরূপ সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতাগত এখতিয়ার এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক সুনির্দিষ্টভাবে বিধিবদ্ধ থাকে। ফলে ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিরােধের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কার্যকরী করার জন্য লিখিত আবশ্যক।
৬. জনমতের প্রতিফলনঃ লিখিত সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কারণ এ সংবিধান সাধারণত কোন গণপরিষদ, সম্মেলন বা কমিশন কর্তৃক রচিত হয়। আর এ গণপরিষদ বা সম্মেলন গঠিত হয় জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে। এভাবে জনপ্রতিনিধিদের আলাপ আলােচনার মাধ্যমে যে সংবিধান প্রণীত হয় তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে।
৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে উপযােগীঃ লিখিত সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় বিশেষ উপযােগী। সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকেই যায়। আবার সংবিধান লিখিত ও স্থায়ী না হলে কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বানচাল করে এককেন্দ্রিক শাসন কায়েম করতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান লিখিত হয়।
৮. দুস্পরিবর্তনীয়ঃ দুস্পরিবর্তনীয়তা লিখিত সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণত সহজে এ সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না এবং এজন্য বিশেষ পন্থা অবলম্বনের প্রয়ােজন হয়। তাই কোন ব্যক্তি বা দল নিজেদের সুবিধামতাে পরিবর্তন করতে পারে না। লিখিত সংবিধান স্থায়িত্বের প্রতীক যা উত্তম সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য।
৯. সংক্ষিপ্ততাঃ লিখিত সংবিধানে প্রধানত রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলাে লিপিবদ্ধ থাকে বলে এটা সংক্ষিপ্ত আকার ধারণ করে। ফলে এরূপ সংবিধান পুস্তক আকারে সর্বসাধারণের নিকট পৌছানাে যায়। ফলে জনগণ সহজেই তার দেশের সংবিধানের মূলনীতিগুলাে সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। ফলে লিখিত সংবিধান সুনাগরিক হওয়ার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১০. গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখেঃ লিখিত সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকে। যেহেতু সহজে পরিবর্তনীয় নয়, সেহেতু ক্ষমতাশীল দল ইচ্ছা করলেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে বা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ফলে গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে।
১১. সাংবিধানিক আইনকে প্রাধান্য দেয়াঃ লিখিত সংবিধানে সাংবিধানিক আইনকে অধিক মর্যাদা দেয়ার প্রবণতা সর্বদাই লক্ষ্য করা যায় এবং সাধারণ আইনের তুলনায় জনসাধারণ এবং সরকারকে এ আইনের প্রতি পবিত্র মনােভাব পােষণ করতে দেখা যায়। সাংবিধানিক আইনকে অধিক মাত্রায় প্রাধান্য দিয়েই সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকেন। ফলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় না।
উপসংহারঃ অবশেষে বলা যায়, একটি দেশের সংবিধান লিখিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। লিখিত সংবিধানের সমস্যা কম বিধায় পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশে লিখিত সংবিধানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এর কার্যকারিতা নির্ভর করে জনগণের নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও সামাজিক মূল্যবােধের উপর।
0 মন্তব্যসমূহ