মহানবী (স) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের কাহিনী ও ফলাফল আলােচনা কর


প্রশ্নঃ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মক্কা বিজয় এবং এর গুরুত্ব ও ফলাফল বর্ণনা কর।
অথবা, মহানবী (স) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের কাহিনী ও ফলাফল আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ অন্ধকারের গহীন তলে লুকিয়ে থাকে আলাের সূর্য। মানবতার মুক্তির দিশারি মহানবী (স)-এর জীবনেও তেমনি যাবতীয় প্রতিকূলতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল বিজয়ের রক্তিম দিনমণি। যে জন্মভূমি থেকে মহানবী (স) ব্যথিত হৃদয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন, পুনরায় ৮ বছর পর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ১০ হাজার মুজাহিদ নিয়ে বিজয়ী বেশে সেই মক্কায় প্রবেশ করেন। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি তাই বলেন, Hardly a triumphant entry is a ricent annals is comparable to tis.
[History of the Arabs P-42]


মক্কা বিজয়ের কারণঃ
প্রত্যক্ষ কারণঃ হােদায়বিয়া সন্ধির শর্ত অনুযায়ী মক্কার বনু খােজায়া এবং বনু বকর গােত্র যথাক্রমে নবী (স) ও কুরাইশদের সঙ্গে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হয়। কিন্তু শর্ত লঙ্ন করে কুরাইশদের সহযােগিতায় বনু বকর গােত্র বনু খােজায়ার ওপর আক্রমণ করে তাদের কয়েকজনকে হত্যা করে। ফলে খােজায়া গােত্রের ৪০ জনের একটি দল রাসূল (স)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে সাহায্যের আবেদন জানায়। রাসূল (স) তাদেরকে সাহায্য প্রদানে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দূত মারফত কুরাইশদের নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করেনঃ 
ক. অন্যায় আক্রমণে খােজায়া গােত্রের নিহতদের রক্তপণ দেয়া হােক।
খ. আক্রমণকারী বনু বকরের সহায়তা বন্ধ করা হােক।
গ. অন্যথায় হােদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল ঘােষণা করা হােক।


পরােক্ষ কারণঃ
১. কুরাইশদের অনৈক্য ও গােত্রস্বার্থঃ বদর যুদ্ধের পর থেকেই মক্কার অভ্যন্তরীণ অবস্থার অবনতি ঘটে। গােত্রে গােত্রে কলহের কারণে তাদের সমরশক্তির চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। বস্তুত কুরাইশদের রাজনৈতিক অনৈক্য ও গােত্রস্বার্থ তাদের শক্তি হ্রাস এবং মুহাম্মদ (স)-এর মক্কা বিজয়কে তুরান্বিত করে।

২. ইসলামী আধিপত্য স্থাপনের ইচ্ছাঃ রাসূল (স) সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন যে, মক্কার শাসন ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ ব্যতীত আরব উপদ্বীপে ইসলাম পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এ বাস্তব ধারণা ও কুরাইশ নেতাসহ কতিপয় মক্কাবাসীর নবী (স)-এর নিকট আত্মসমর্পণই তাঁকে মক্কা বিজয়ে প্রেরণা যােগায়।

৩. তরুণদের ইসলাম গ্রহণঃ মহানবী (স)-এর উদারতা ও ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস ও ওসমান ইবনে তালহার মতাে নবীন বীরদের ইসলাম গ্রহণ মক্কার ধর্মান্ধ পৌত্তলিকদেরও বিশ্বাসের ভীত নেড়ে দেয়। সুতরাং মক্কার তরুণ সম্প্রদায়ের ইসলাম গ্রহণ এবং বয়ােবৃদ্ধদের মনে প্রতিক্রিয়ার ফলে মক্কা বিজয়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

৪. কাবার সম্মান রক্ষাঃ মুসলমানদের কিবলা হলাে পবিত্র কাবাঘর। অথচ এ কাবাঘরকে পৌত্তলিকরা ৩৬০টি মূর্তির দ্বারা পঙ্কিলযুক্ত করে রেখেছিল। কাজেই কাবা ঘরকে মুক্ত করতে হলে মক্কা বিজয়ের কোনাে বিকল্প নেই।

৫. হােদায়বিয়ার সন্ধিঃ মাত্র দুই বছরের মাথায় কুরাইশরা হােদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করলে মহানবী (স) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

মক্কা বিজয়ের ঘটনাঃ
১. মহানবী (স)-এর মক্কাযাত্রাঃ হােদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ এবং কুরাইশদের উসকানিমূলক কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে মহানবী (স) অষ্টম হিজরীতে বিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রায় দশ হাজার সৈন্যসহ মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন।

২. মক্কাবাসীর উদ্দেশে ঘােষণাঃ আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করলে মহানবী (স) মক্কাবাসীর উদ্দেশে ঘােষণা দেন, যারা কাবাঘরে, নিজ গৃহে বা আবু সুফিয়ানের গৃহে অবস্থান অথবা আত্মসমর্পণ করবে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।

৩. সামান্য যুদ্ধঃ মহানবী (স) তার বাহিনীকে মক্কার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, যতক্ষণ কেউ তােমাদের সাথে যুদ্ধ না করবে ততক্ষণ তােমরাও যুদ্ধ করবে না। মুসলিম বাহিনীর একটা অংশকে কুরাইশরা বাধা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। ইকরামা ও সাফওয়ানের হাতে দু’জন মুসলিম সেনা শহীদ হন। জবাবে হয়রত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ প্রতিশােধ নিতে শুরু করলে কুরাইশদেরও কয়েকজন নিহত হয়।

৪. মক্কা বিজয়ঃ বিজয়ী বেশে মহানবী (স) মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি তাকবীর ধ্বনি দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে আল্লাহর ঘরে শােকরানা নামায আদায় করেন।

৫. সাধারণ ক্ষমা ঘােষণাঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন মুহাম্মদ (স)-এর মক্কা বিজয়ের পর তার একান্ত শক্ররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু তিনি সবার উদ্দেশে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে বলেন, “তােমাদের বিরুদ্ধে আজ কোনাে অভিযোগ নেই। যাও, তােমরা সকলে মুক্ত।”

মক্কা বিজয়ের ফলাফলঃ
১. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারঃ মহানবী (স) ও তার সাহাবীগণ এতােদিন আতঙ্ক ও ভয়ভীতির মধ্যে ইসলাম প্রচার করতেন। মক্কা বিজয়ের ফলে ইসলাম এক অপ্রতিরােধ্য অদম্য মহাপ্লাবনের মতােই বাধা বন্ধনমুক্ত বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. উদারতা ও ক্ষমার বিজয়ঃ করুণার মূর্ত প্রতীক মহানবী (স) মক্কা বিজয় করে মক্কাবাসীর প্রতি উদারতা প্রদর্শন করেন। তিনি তাদের প্রতি যে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি দান করেন। বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই বিরল।

৩. বাবার গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠাঃ এ বিজয়ের ফলে পবিত্র কাবাঘরে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করা হলাে। কাবাগৃহের পবিত্রতা ও গৌরব ফিরে এল। পবিত্র কাবা এলাকা চিরদিনের জন্য অমুসলিমদের আওতার বাইরে চলে গেল।

৪. বিশ্ব বিজয়ের সূচনাঃ এ বিজয়ে মুসলিম হৃদয় বিশ্ব বিজয়ের ধারণা ও শক্তি সঞ্চয় করে। এ বিজয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখা বহুদূর বিস্তৃত হয়। রাসূল (স)-এর জীবদ্দশায় কয়েকটি দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

৫. মিথ্যার ওপর সত্যের জয়ঃ এ বিজয় ছিল মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়। অন্যায়ের ওপর ন্যায়ের। অন্ধকারের ওপর আলাের। মহান আল্লাহ ঘােষণা করেন, “সত্য সমাগত, মিথ্যা পরাভূত।”

৬. অহংকারের পরাজয়ঃ ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, কুরাইশরা সর্বদাই নিজেদের বড় মনে করত, কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর তাদের সে অহংকার চূর্ণ হয়ে যায়।

৭. রাজনৈতিক প্রভাবঃ মক্কা বিজয়ের ফলে মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। ঐতিহাসিক নিকলসন বলেন, মক্কাবাসীর আত্মসমর্পণে আরব উপদ্বীপে মহানবী (স)-এর আর কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।

৮. মক্কায় ইসলামী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ এ বিজয়ের ফলে মহানবী (স) নিজ মাতৃভূমি মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সমগ্র আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৯. পৌত্তলিকতার অবসানঃ মহানবী (স)-এর উদারতায় মুগ্ধ হয়ে পৌত্তলিকগণ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। এমনকি আরবের বেদুইনরাও ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে মক্কা থেকে পৌত্তলিকতার চির অবসান ঘটে।

১০. একত্ববাদের প্রতিষ্ঠাঃ এ বিজয়ের ফলে মক্কা ও নিকটবর্তী এলাকাগুলােতে এক আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়, যাকে ইসলামের পরিভাষায় একত্ববাদ প্রতিষ্ঠাও বলা যায়।

১১. জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠাঃ মক্কা বিজয়ের ফলে মুসলমানগণ একটি প্রতিষ্ঠিত জাতি হিসেবে পৃথিবীতে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। সমগ্র আরবে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মহানবী (স) আরব উপদ্বীপের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে স্বীকৃত হলেন।

১২. ইসলাম প্রচারের নতুন দিগন্তঃ মক্কা বিজয়ের ফলে মুসলমানগণ নতুন জীবন লাভ করেন। তাদের কণ্ঠে নতুন ভাষা, বক্ষে নতুন আশা ও নতুন উদ্দীপনা নিয়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। যার ঢেউ বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

১৩. প্রকাশ্য ইবাদতের সুযােগঃ হিজরতের পূর্বে মুসলমানগণ প্রকাশ্যে ইবাদত করার সুযােগ পায়নি। মক্কা বিজয়ের ফলে মুসলমানদের চিরকালের জন্য প্রকাশ্যে ইবাদত তথা আযান, নামায, হজ্জ ও ওমরা পালন করার সুযােগ সৃষ্টি হলাে।

১৪. নিরাপদে বসবাসঃ মদিনার মুসলমানগণ শত্রুর ভয়ে সব সময় আতঙ্কিত থাকতেন। কুরাইশরা যে কোনাে মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে এ ভয়ে মুসরমানগণ রণ প্রস্তুতিতে থাকতেন। এখন আর সে চিন্তা থাকল না।

১৫. দলে দলে ইসলাম গ্রহণঃ মক্কা বিজয়ের ফলে সমগ্র আরবের লােক দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স)-কে যে সংবাদ দিয়েছেন তা সত্যিই চমৎকার। আল কুরআনের বাণী, “আর তুমি লোকদেরকে দলে দলে আল্লাহর দীনে দাখিল হতে দেখবে”

উপসংহারঃ এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ (স) তার দীর্ঘ দিনের সাধনার চরম শিখরে উপনীত হলেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মক্কা একত্ববাদের অনাবিল আলােকে আলােকায়িত হয়ে উঠল। সারা বিশ্ব এক অভিনব বিজয়ের সাফল্যের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তাই ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন- That throUgh all the annals of conquest there has been up triumphant entry like upto this one.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক