নীতিবিদ্যার প্রকৃতি ও পরিধি আলােচনা কর

প্রশ্নঃ নীতিবিদ্যার প্রকৃতি ও পরিধি আলােচনা কর।
অথবা, নীতিবিদ্যার স্বরূপ ও বিষয়বস্তু আলােচনা কর।
অথবা, নীতিবিদ্যার স্বরূপ ও পরিসর ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ আচরণের ন্যায় বা ভালাে নিয়ে যে আলােচনা করা হয়, তাকে নীতিবিদ্যা বলা হয়। এ বিদ্যা আচরণ সম্পর্কীয় সাধারণ মতবাদ এবং এ বিদ্যা ন্যায় বা অন্যায় ও ভালাে বা মন্দ প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্রিয়াবলির আলােচনা করে। নীতিবিদ্যা হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পৰ্কীয় এমন একটা আদর্শনিষ্ঠ। বিজ্ঞান যা এই আচরণকে ন্যায় বা অন্যায়, ভালাে বা মন্দ, বা অন্য কোনাে একই ধরনের পন্থায় বিচার করে। নিম্নে নীতি বিদ্যার স্বরূপ ও বিষয়বস্তু আলােকপাত করা হলাে।

নীতিবিদ্যার স্বরূপঃ নীতিবিদ্যার অর্থ পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, নীতিবিদ্যা হলাে নৈতিক ও নৈতিকতা সম্পর্কীয় সমস্যা এবং অবধারণ বিষয়ক এমন একটা দার্শনিক চিন্তন, যা নৈতিক সূত্র বিশ্বাস ও অনুশীলনের তাত্ত্বিক আলােচনা করে। এ তিন ধরনের চিন্তনের আলােচনার প্রেক্ষিতে নীতিবিদ্যার স্বরূপকে বুঝার চেষ্টা করাই শ্রেয় বলে মনে করা হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

১. বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানঃ বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানে বস্তুর উৎপত্তি, বিকাশ ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া হয়। মনােবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানকে বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। মনােবিজ্ঞানে বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়াগুলােকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং এদের সাধারণ নিয়মাবলি আবিষ্কার করা হয়।

২. আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানঃ আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান একটা আদর্শের মাপকাঠিতে বিষয়বস্তুর মূল্য নির্ধারণ করে। নীতিবিজ্ঞানকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। কারণ এ বিজ্ঞান পরমার্থের আদর্শের মানদণ্ডে মানুষের আচরণের মূল্য নির্ধারণ করে।

৩ ঐতিহাসিক চিন্তনঃ ঐতিহাসিক এক ধরনের মূলক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক অনুসন্ধান রয়েছে যা নৃতত্ত্ববিদ ঐতিহাসিক মনােবিদ এবং সমাজবিদেরা মনে করেন। এ ধরনের অনুসন্ধানের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নৈতিকতা সম্পর্কীয় ঘটনার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেওয়া। নীতিবিদ্যা মানব জীবনের আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। এ সংজ্ঞায় বিজ্ঞান শব্দটির উপর গুরুত্বারােপ করে অনেক বর্ণনামূলক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক অনুসন্ধানের উপর বিশেষভাবে জোর দেন বলে নীতিবিদ্যাকে বর্ণনামূলক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিজ্ঞানের মত গণ্য করে নীতিবিদ্যার স্বরূপকে বুঝার চেষ্টা করেন।

৪. মানদন্ডেরে প্রেক্ষিতে আচরণের মূল্যায়নঃ নীতিবিদ্যার কাজ আচরণের বিচারমূলক আলােচনা ও মূল্যায়ন করা। নীতিবিদ্যা জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে আলােচনা করে। পরম উদ্দেশ্য হলাে সাধারণত জীবনের পরম কল্যাণ নামে পরিচিত। নীতিবিদ্যা জীবনের পরম লক্ষ্য নিয়ে অনুসন্ধান করে।

আদর্শনিষ্ঠ নীতিবিদ্যার আলােচনাতে বিভিন্ন ধরনের আদর্শনিষ্ঠ অবধারণ। যেমন- তােমার কাজটি করা উচিত, কাউকে আঘাত করা অন্যায় ইত্যাদি গঠন করা হয় এবং এগুলাের যথার্থতা নিরূপণের জন্য যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। তাদের মতে নীতিবিদ্যা বর্ণনামূলক; অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিজ্ঞান নয়। বরং আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান।

৫. বিশ্লেষণধর্মী চিন্তনঃ নীতিবিদ্যার আলােচনায় বিশ্লেষণ ধর্মী, বিচারধর্মী চিন্তর ও পরিলক্ষিত হয়। সক্রেটিস তার বন্ধু ক্ৰিটোর প্রস্তাব প্রত্যাখান করার উদ্দেশ্যে সেসব আদর্শনিষ্ঠ অবধারণ। যেমনঃ কাউকে আমাদের আঘাত করা উচিত নয়। এ গুলাের যৌক্তিকতা প্রশ্ন উত্থাপন করলে তা পরানীতি বিদ্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন হয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে সক্রেটিস যদিও মৌলিক কথা তুলে ধরেন এবং তার আলােচনাতে বিশ্লেষণী চিন্তনের বীজ পরিলক্ষিত হয়।

নীতিবিদ্যার বিষয়বস্তুঃ নীতিবিদ্যা যেসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করে সেগুলােই নীতিবিদ্যার আলােচনার বিষয়বস্তু। সাধারণত নীতিবিদ্যাকে আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান বলা হয়ে থাকে। নিচে নীতিবিদ্যার আলােনার বিষয়বস্তু আলােচনা করা হলাে।

১. সুনিশ্চিত জ্ঞানঃ প্রতিটি বিজ্ঞান-ই প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর যথাযথ ও সুনিশ্চিত জ্ঞান দান করে। নীতিবিজ্ঞানও একটি বিজ্ঞান। নীতি বিদ্যারও একটি নির্দিষ্ট বিষয় আছে। যার উপর যথাযথ ও সুনিশ্চিত জ্ঞান দান করে।

২. নৈতিক বিচারঃ নীতিবিজ্ঞান মানুষের আচরণের নৈতিক বিচার করে। নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে নৈতিক আদর্শ কি হবে তার আলােচনাও নীতিবিদ্যায় এসে পড়ে। নৈতিক আদর্শ সম্পর্কে একাধিক মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- সুখবাদ, উপযােগবাদ, পূর্ণতাবাদ।

৩. নৈতিক গুণঃ নীতিবিদ্যায় নৈতিক বিচার যেমন প্রয়ােজন, তেমনি আবার নৈতিক গুণের আলােচনারও প্রয়ােজন। কাজেই, নৈতিক বিচারের জন্য নৈতিক গুণাবলির আলােচনাও নীতিবিদ্যায় এসে পড়ে। কাজেই ভালাে-মন্দ, উচিত অনুচিত, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ ইত্যাদি নৈতিকগুণাবলির প্রকৃত অর্থ ও নীতিবিদ্যার আলােচ্য বিষয়।

৪. ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল্যায়নঃ নীতিবিজ্ঞানের কাজ হলাে ঐচ্ছিক ক্রিয়ার নৈতিক মূল্যায়ন করা। কিন্তু ঐচ্ছিক ক্রিয়ার আবার বিভিন্ন স্তর আছে। যেমন মানসিক স্তর, দৈহিক স্তর এবং পরিসমাপ্তি স্তর। এই ৩টি স্তরের মধ্যে নৈতিক বিচার কোন স্তরের ক্রিয়ার করা হয়। তার উল্লেখ করতে গিয়ে ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর নিয়ে আলােচনা করতে হয়।

৫. নৈতিক বাধ্যবাধকতাঃ নৈতিক বিচার নৈতিক বাধ্যবাধকতার সাথে যুক্ত। নৈতিক বাধ্যবাধকতা হলাে কোনাে কাজ যা আমার কাছে ভালাে বলে মনে হওয়ার পর ঐ কাজ সম্পাদন করার যে তাগিদ আমার মধ্যে জাগে।

৬. গৌরব-অগৌরবঃ আমরা যখন কোনাে ভালাে কাজ করি, তখন সেই কাজের জন্য আমরা গৌরববােধ করি। তেমনি আবার যে কাজ মন্দ সেই কাজের জন্য আমাদের অগৌরববােধ হয়। কাজেই এটাও নীতিবিদ্যার আলােচ্য বিষয়।

৭. কর্তব্যবোধঃ নীতিবিদ্যার আলােচ্য বিষয়ের মধ্যে কর্তব্য অধিকার, সততা ইত্যাদিকেও অন্তর্ভুক্ত করা। যেমনঃ পিতার প্রতি পুত্রের কর্তব্য পালন, পিতার কাছে পুত্রের অধিকার ইত্যাদি।

৮.ভাবাবেগঃ নৈতিক ভাবাবেগ হলাে একটি মানসিক অনুভূতি যা কোনাে ভালাে কাজ বা কোনাে মন্দ কাজ করার পর আমরা অনুভব করি। যেমন- কোনাে সৎ কাজ করার পর আমাদের মনে প্রীতির সষ্টি হয়।

৯. নৈতিক আদর্শঃ নীতিবিদ্যার একটা প্রধান উদ্দেশ্য হলাে সমগ্র মানব জাতির মধ্যে একটা নৈতিকভাবে গডে তােলা। তাই নীতিবিদ্যা নৈতিক আদর্শ ও প্রগতি সম্পৰ্কীয় বিষয় নিয়েও আলােচনা করে।

১০. নৈতিক ধর্মঃ নৈতিকতার সাথে ধর্মের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে বলে নৈতিক ধর্ম সম্পৰ্কীয় বিভিন্ন মত ও অনেকক্ষেত্রে নীতিবিদ্যার আলােচনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।

১১. নৈতিক সমস্যাঃ নৈতিক সমস্যা নীতিবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিভিন্ন নৈতিক, সমস্যা নীতিবিদ্যার আলােচনার অন্তর্ভুক্ত।

১২. নৈতিকতায় সমাজঃ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক থেকে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি নৈতিকতার দিক থেকে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। নৈতিকতা বিকাশের জন্য সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৩. নৈতিক অবধারণঃ নীতিবিদ্যা নৈতিক অবধারণের কর্তা এবং বিষয়বস্তু নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে বিবেক, নৈতিকবৃত্তি, পরিণামদর্শিতা ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে।

১৪. নৈতিক অবধারণের স্বীকার্য সত্যঃ নৈতিক অবধারণের কতকগুলাে স্বীকার্য সত্য আছে বলে ইচ্ছার স্বাধীনতা, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা নীতিবিদ্যায় করা হয়।

১৫. নৈতিক নিয়ন্ত্রণঃ নৈতিক নিয়ন্ত্রণ এমন এক ধরনের অনুশাসন যা আমাদেরকে নৈতিক নিয়ম পালন করতে বাধ্য করে। নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বলতে কি বুঝি এবং নৈতিক নিয়ন্ত্রণের নীতিবিদ্যায় আলােচনা করা হয়।

১৬. সমকালীন মতবাদঃ নৈতিক অবধারণের স্বরূপ সম্পর্কে প্রকৃতিবাদ, অপ্রকৃতিবাদ, আবেগবাদ, নির্দেশবাদ, বর্ণনাবাদ ইত্যাদি যেসব সমকালীন মতবাদ আছে, সেগুলােও নীতিবিদ্যার আলােচনার পরিধিতে পড়ে।

১৭. নৈতিক মানদণ্ডঃ নৈতিক মানদণ্ড অনুসারে মানুষের ক্রিয়াবলির ভালােত্ব, মন্দত্ব ইত্যাদি নিরূপণ করা হয়। নৈতিক মানদণ্ড প্রসঙ্গে আদর্শনিষ্ঠ নীতিবিদরা বিভিন্ন মত পােষণ করেন। নীতিবিদরা এসব মানদণ্ড এবং এর মতবাদ আলােচনা করে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নীতিবিদ্যা মানব জীবনের পরম কল্যাণ লাভে সহায়ক। যে নৈতিক নিয়মগুলাে পালন করলে মানুষ তার জীবনের পরম কল্যাণ লাভ করতে পারে তা আলােচনা করায় চেষ্টা নীতিবিদ্যা। পরম কল্যাণের ব্যাখ্যা দেওয়াই নীতিবিদ্যার প্রধান আলােচ্য বিষয়। তাই নীতিবিদ্যা মানুষের সত্তা, আত্মার অমরতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা, ঈশ্বরের স্বরূপ ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে। এভাবে নীতিবিদ্যা পরম আদর্শের প্রকৃত মূল্যায়ন করে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক