খন্দকের যুদ্ধকে ‘আহযাবের যুদ্ধ’ বলা হয় কেন? এ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বা গুরুত্ব বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ খন্দকের যুদ্ধ সম্বন্ধে যা জান সংক্ষেপে আলােচনা কর।
অথবা, খন্দকের যুদ্ধকে ‘আহযাবের যুদ্ধ’ বলা হয় কেন? এ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বা গুরুত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, খন্দকের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ মহানবী (স) ইসলামের অমর জ্যোতি তিমিরবিদারী সূর্যের আলাের মতােই চারদিকে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। আর কাফেরদের অন্তরে তা বিষাক্ত তীরের মতাে বিদ্ধ হতে থাকে। উহুদের যুদ্ধে সাময়িক বিজয়ী কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আবারও রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করে, যার ফলে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধ। স্যার সৈয়দ আমীর আলী এ যুদ্ধকে Bottle of the Confederates বলে অভিহিত করেছেন।

যুদ্ধের বিভিন্ন নামকরণঃ
১. খন্দক নামকরণঃ খন্দক আরবি শব্দ, এর অর্থ পরিখা। এ যুদ্ধে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সালমান ফারেসি (রা)-এর পরামর্শে ও মজলিসে শূরার সিদ্ধান্তে মদিনার উন্মুক্ত দিকে পাঁচ হাত প্রস্থ ও পাঁচ হাত গভীর এক পরিখা খনন করে মদিনার সংরক্ষণ করা হয়েছিল, তাই এ যুদ্ধকে পরিখা বা খন্দকের যুদ্ধ বলা হয়।

২. আহযাব নামকরণঃ পবিত্র কুরআনে খন্দকের যুদ্ধকে ‘আহযাব’ যুদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবিতে আহযাব শব্দের অর্থ দলসমূহ, গােত্রসমূহ। এ যুদ্ধে বহুদলীয় জোট একত্রে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে বিধায় এর নামকরণ করা হয় আহযাবের যুদ্ধ।

৩. মদিনা অববােধঃ শত্রুরা কয়েকদিনের জন্য মদিনার সীমানা অবরােধ করে রেখেছিল বলে এটা মদিনার অবরােধ Siege of Madinah নামে পরিচিত।

খন্দকের যুদ্ধের কারণঃ
১. বনু নযির গােত্রের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতাঃ ষড়যন্ত্রের অভিযোেগ বনু নযির গােত্রকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। অতঃপর তারা খায়বারে আশ্রয় গ্রহণ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারা কুরাইশ ও অন্যদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্ররােচিত করতে থাকে।

২. মদিনা রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধিঃ মদিনা রাষ্ট্রের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি ইসলামদ্রোহী কুরাইশ এবং ইহুদিরা সহ্য করতে পারেনি। তাই তারা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়।

৩. ইসলামের শক্তি বৃদ্ধিঃ বদর ও উহুদে যুদ্ধ করেও মুসলমানগণ ক্লান্ত হয়ে পড়েনি; বরং ইসলাম প্রচারে তাদের প্রেরণা ছিল প্রত্যয়দৃপ্ত। আর কাফেররা তা সহ্য করতে পারছিল না বলে যুদ্ধ ঘনীভূত হয়।

৪. ইহুদিদের ষড়যন্ত্রঃ ইহুদিরা মদিনা হতে বহিষ্কৃত হয়ে খায়বারের ওয়াদীউল কুরা এবং সিরিয়ার বাণিজ্য পথের অন্যান্য জায়গায় বসতি স্থাপন করে। তারা সেখানকার স্থানীয় লােকদের নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং মদিনায় নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস করতে কুরাইশদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।

৫. মুসলমানদের সংকল্পঃ ঐতিহাসিক মুর বলেন, উহুদ যুদ্ধের পর মুসলমানরা কুরাইশদের সমুচিত শিক্ষা দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই সময়মতাে ইসলাম রক্ষার স্বার্থেই তাদের যুদ্ধে অবতরণ করতে হয়।

৬. বেদুইনদের হঠকারিতাঃ মদিনার সুলাইম, আশজা, গাতফান, ফায়ারা প্রভৃতি বেদুইন গােত্রগুলাে ইসলামের বিধি-নিষেধ অমান্য করে লুটতরাজ ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। মহানবী (স) এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা শুরু করে। পরবর্তীতে কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য ৬০০০ সৈন্য প্রেরণ করে।

৭. বাণিজ্যপথ নির্বিঘ্নকরণঃ বিগত দুটি যুদ্ধের মাধ্যমেও কুরাইশরা সিরিয়া অভিমখী তাদের বাণিজ্যপথ নির্বিঘ্ন করতে পারেনি। সে জন্য তারা নতুনভাবে যুদ্ধ করে তাদের সিরিয়া অভিমুখী বাণিজ্যপথ নির্বিঘ্ন করতে চেয়েছিল।

৮. গােপন তথ্য ফাঁসঃ ইহুদি সম্প্রদায় মদিনার যাবতীয় গােপন তথ্য কুরাইশদের নিকট ফাঁস করে দেয়। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

৯. সম্মিলিত বাহিনীর রণপ্রস্তুতিঃ ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে না পেরে আরবের সকল গােত্র একত্রিত হয়ে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে মদিনা আক্রমণের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহঃ
১. ত্রিশক্তির যুদ্ধপ্রস্তুতিঃ হিজরী পঞ্চম সাল মােতাবেক ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ কুরাইশ, ইহুদি ও বেদুইনদের এক সম্মিলিত বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদিনা অবরােধ করার লক্ষ্যে খন্দক প্রান্তরে উপস্থিত হয়।

২. হযরতের সিদ্ধান্তঃ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ থেকে মদিনাকে রক্ষার কল্পে রাসূল (স) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার তারা শহরের ভেতর থেকে শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিরােধ করবেন। অতঃপর বিশিষ্ট সাহাবী সালমান ফারেসির পরামর্শে ৩,০০০ মুসলিম সৈন্যের সাহায্যে মদিনার অরক্ষিত স্থানে গভীর পরিখা খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

৩. পরিখা খননঃ পরিখা খননের কার্য আরম্ভ হলাে তিন হাজার আনসার ও মুহাজির কঠোর পরিশ্রম করে প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে খননকার্য শেষ করলেন। খনন কার্য শেষ হতে না হতেই কুরাইশ বাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হলো এবং মদিনা রক্ষার অভিনব কৌশল দেখে তারা বিস্মিত হলাে।

৪. কুরাইশদের পলায়নঃ পরিখা অতিক্রম করে হামলা চালাতে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী ২৭ দিন মদিনা অবরােধ করে রাখে। অবশেষে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসা প্রচণ্ড ঝড় ও মারাত্মক খাদ্যাভাবে তারা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যুদ্ধ ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে এবং তাদের ত্রিশক্তির ঐক্যের সেখানেই সমাপ্তি ঘটে।

কুরাইশদের ব্যর্থতার কারণঃ খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশদের ব্যর্থতার মূলে যে সমস্ত করণ ছিল তন্মধ্যে রাসূল (স)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, উন্নত রণকৌশল এবং গুপ্ত সংবাদ সরবরাহ সংস্থার কার্যাবলি প্রধান। অপরদিকে সম্মিলিত কুরাইশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ও সদ্ভাবের অভাব কুরাইশদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল। সর্বোপরি বিপদে ধৈর্য, একতা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় মুসলিম বাহিনীর ইস্পাত কঠিন শপথ কুরাইশদের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে।

যুদ্ধের ফলাফল/গুরুত্বঃ
১. অহংকারের পতনঃ খন্দক যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সকল অহংকারের পতন ঘটিয়ে দেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “আল্লাহ অহংকারীদের ভালােবাসেন না।”

২. কুরাইশদের ভরাডুবিঃ ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশদের শক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয় এবং মুসলমানদের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এ যুদ্ধে কুরাইশদের সামরিক ও নৈতিক শক্তির চরম দুর্বলতা প্রকাশ পায় এবং তাদের ভরাডুবি হয়।

৩. মুনাফিক চিহ্নিত হয়ঃ খন্দকের যুদ্ধের মাধ্যমে মদিনায় কারা কারা মুনাফিক তা চিহ্নিত হয়ে যায়। কেননা বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদি ও মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বহিঃশত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে ছিল। এতে মুখােশধারী মুসলমানদের স্বরূপ উন্মােচিত হয়ে যায়।

৪. নতুন দিগন্ত উন্মােচনঃ এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের অগ্রগতির ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মােচিত হয়। অধ্যাপক আবদুল খালেক বলেন, আহযাব যুদ্ধের পর থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের অবিচ্ছিন্ন বিজয় আরম্ভ হয়।

৫. সত্য প্রতিষ্ঠাঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, এ যুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠিত আর মিথ্যা পদানত হয়। যেহেতু মিথ্যা অস্পষ্ট এবং সত্য সুস্পষ্ট।

৬. মহানবী (স)-কে নেতা হিসেবে স্বীকৃতিঃ এ যুদ্ধে বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর লােকেরা মহানবী (স)-এর রণকৌশল প্রত্যক্ষ করে তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে।

৭. খােদায়ী শক্তি অপরাজেয় প্রমাণিতঃ ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, এ যুদ্ধে বিশ্বাস, শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগ ও খােদায়ী বলে বলীয়ান মুসলিম শক্তি অপ্রতিরােধ্য ও অপরাজেয় প্রমাণিত হয়। সে জন্য এ যুদ্ধকে মহাবিজয়ের সূতিকাগার বলা হয়।

৮. ইহুদিদের বহিষ্কারঃ ড. এস. এম. ইমামুদ্দিন বলেন, খন্দক যুদ্ধের পর বিশ্বাসঘাতক ইহুদি গােত্রসমূহ মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়, ফলে মদিনা রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র মুক্ত হয়ে ওঠে।

৯, মদিনা রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলঃ ড. এস. এম. ইমামুদ্দীনের মতে, এ যুদ্ধের মাধ্যমে মদিনার ইহুদি, মক্কার কুরাইশ এবং বেদুইন গােত্রসমূহের ঐক্যে ফাটল ধরার ফলে মক্কাবাসীদের সম্পূর্ণ পরাজয় প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং তা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করে।

১০. মুসলমানদের ঈমানী শক্তি বৃদ্ধিঃ খন্দকের যুদ্ধে সম্মিলিত কুরাইশ বাহিনীকে কৌশলের মাধ্যমে বিপর্যস্ত করায় রাসূল (স) ও ইসলামের প্রতি মুসলমানদের ঈমান আরাে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

১১. মহানবী (স)-এর উদারতা প্রকাশঃ খন্দকের যুদ্ধের ফলে মহানবী (স)-এর উদারতার প্রকাশ ঘটে। কারণ এ যুদ্ধে পরিখা খননের সময় অন্যদের মতাে মহানবী (স) নিজেও মাটি বহন করেছিলেন।

১২. শৃঙ্খলার বিজয়ঃ ঐতিহাসিক জোশেফ হেল যথার্থই বলেন, এ যুদ্ধের ফলাফল ছিল সংখ্যাগুরু বৃহৎ শক্তির ওপর শৃঙ্খলা ও একতার নব বিজয়।

১৩. ইসলামের প্রসারঃ এ যুদ্ধের পর আরব উপদ্বীপে ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করে এবং আরবের অনেক গােত্র মদিনা রাষ্ট্রের সাথে স্বেচ্ছায় মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধ হয়।

১৪. রণকৌশল প্রমাণঃ ঐতিহাসিক ইমামুদ্দিন বলেন, মহানবী (স) পরিখা খনন করে মদিনা সংরক্ষণ করে এ যুদ্ধের মাধ্যমে রণদূরদর্শিতা প্রমাণ করেন।

১৫. ইসলামের মহাবিজয়ঃ খন্দকের যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের মহাবিজয় সূৰ্চিত হয়। তাই জনৈক ঐতিহাসিক এ যুদ্ধকে মহাবিজয়ের সূতিকাগার বলে অভিহিত করেছেন।

উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলােচনায় প্রতীয়মান হয়, খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ও যুগান্তকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সম্মিলিত খােদাদ্রোহী শক্তি চরমভাবে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আর মহানবী (স) বিজয়ী বেশে বিশ্বের বুকে ইসলামের অমীয় বাণী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক